৬ বছরে ভয়াল গুইমারা : ট্রাজেডি সুষ্ঠ বিচার আজো প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: ভয়াল ১৭ এপ্রিল এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম। ২০১১ সালের এ দিনে ভুমি বিরোধকে কেন্দ্র করে স্বার্থনীশি মহলের ইন্ধনে পাহাড়ি-বাঙ্গালীর মধ্যে জ্বলে উঠে অশান্তির আগুন। পুড়ে ছাই হয় স্থানীয় পাহাড়ী-বাঙ্গালীর প্রায় দু’শতাধিক ঘর-বাড়ি ও আভাষস্থল। উপজাতীয় স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ দেয় নিরিহ তিন বাঙ্গালী শ্রমিক।

এ ঘটনার ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ভয়াল গুইমারা বড়পিলাকের ট্টাজেডি শুধুই স্মৃতি। প্রাণ সংঘাতের এ ঘটনার পরও সুষ্ঠ বিচার নিয়ে হতাশ বড়পিলাকের নিহত-আহত ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো। ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান গুইমারা উপজেলার বড়পিলাক কচু বাউন্তী এলাকায় উপজাতীয় স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ও বাঙ্গালীদের ধারলো অস্ত্রের এলোপাথাড়ি আঘাতে নিহত হয়-নোয়াব আলী, আয়ুব আলী ও সুনিল চন্দ্র সরকার। এ ঘটনায় আহত হয় প্রায় অর্ধ শতাদিক এলাকাবাসী।

৬ বছরে ভয়াল গুইমারা : ট্রাজেডি সুষ্ঠ বিচার আজো প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধএ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাফছড়ি ইউনিয়নের উত্তর শণখোলাপাড়া ও রেয়ং মরং পাড়ায় এবং মানিকছড়ির মহামুনি কার্বারী পাড়ায় উত্তেজিত জনতা পাল্টাপাল্টি নিরহ পাহাড়ি-বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র্র করে তৎকালে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ বাঙালীরা বিক্ষোভ মিছিল করে রাস্তায় নেমে এসে চট্টগ্রাম-ফেনী-খাগড়াছড়ি সড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাংচুর করে। অন্যদিকে বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়িরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ফলে মানিকছড়ি ও গুইমারা উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালির মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাৎক্ষণিক ভাবে রাস্তায় নেমে আসে। পাশাপাশি মানিকছড়ি, গুইমারা ও রামগড় তিন উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

তবে যে জায়গা নিয়ে রক্তপাত হানাহানি ঘটলেও সে জায়গায় বাঙ্গালীরা আজও যেতে পারেনি। কোন সমাধান না হওয়ায় শঙ্কিত এলাকাবাসী। যে কোন সময় এ ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা উঠিয়ে দিচ্ছে না স্থানীয় এলাকাবাসী। এ ঘটনায় হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করে। হত্যা মামলায় ৫জনকে চিহিৃত করে করে অজ্ঞাত দুই/আড়াইশ উপজাতীয় সন্ত্রাসীকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলা নং-১,তারিখ-১৮-৪-২০১১ইং। এছাড়াও অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনায় অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করে অপর একটি মামলা করে পুলিশ। মামালা নং-২, তাং-১৯-৪-২০১১ইং।

৬ বছরে ভয়াল গুইমারা : ট্রাজেডি সুষ্ঠ বিচার আজো প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধএ পরিস্থিতিতে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দিপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ি সাংসদ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো: জাহেদুল আলমসহ সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেয়। তার পর সে প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়ন হয়নি।  এরপর তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো: সালা উদ্দিনের নেতৃত্বে অন্য দুই সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন সাইদী ও রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোপাল চন্দ্র দাসকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তদন্ত কাজ শুরু করেন এবং এর রিপোর্টও জমা দেন। কিন্তু এত কিছুর পরও অদ্যাবধি এ হত্যাকান্ডের কোন বিচার পায়নি নিহতের পরিবারগুলো। এদিকে দীর্ঘ প্রায় এক বছর মামলার বাদী এসআই মঞ্জুরুল আবছার তদন্ত করার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা বাদী হওয়ায় এসআই মুঞ্জুরুল আবছারের পরিবর্তে এসআই ঠাকুর দাস মন্ডলকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব প্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা ঠাকুর দাস মন্ডল মাত্র ১৫ দিনের তদন্তে দায়সারা ভাবে ১১-০৮-১২ তারিখে মামলার চূড়ান্ত চার্জসিট প্রদান করে। তার তদন্তে হত্যা মামলায় ৩১জন উপজাতি এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মামলায় ২৮জন বাঙ্গালীকে চিহিৃত করে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আসামি করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ।

অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মামলায় ২৮জন বাঙ্গালী আসামি ২০১৩ সালে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পায়। দীর্ঘ কয়েক বছর মামলা চলার পর মামলা থেকে বেকোসর খালাস পান ২৮বাঙ্গালী আসামি। এদিকে তিন বাঙ্গালী শ্রমিক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৩১জন উপজাতীয় আসামির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও অদৃশ্য কারণে আসামিরা দীর্ঘ কয়েক বছর আদালতে হাজির হয়নি। সম্প্রতি সময়ে আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলে বিজ্ঞ আদালত তাদের জামিন নামুঞ্জুর করে আসামিদের জেল হাজতে পাঠান। পরবর্তীতে বিভিন্ন তারিখে জামিনে রেব হয়ে আসে আসামিরা। বর্তমানে হত্যা মামলাটি বিচারাধীন।

সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ওয়াদুদ ভূইয়া ১৭ এপ্রিল বড়পিলাক হত্যা ট্্রাজেডির ৬ষ্ঠ বার্ষিকীতে ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন, এ ঘটনায় নিহতদের তিনটি পরিবার আজ অনাহারে-অর্ধাহারে অমানবিক ভাবে জীবন যাপন করছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক কর্তারা তাৎক্ষণিক ভাবে নানান আশ্বাস দিলেও এখনো এসব বাস্তবায়ন না করায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের অভিলম্বে গ্রেফতার পূর্বক বিচারের দাবি করেন।

এছাড়াও পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এ্যাডভোকেট এয়াকুব আলী চৌধুরী জানান, নিহতদের পরিবারগুলো এখনো অনাহারে-অর্ধহারে দিনাতিপাত করছে। তাই দ্রুত নিহত পরিবারেরর প্রতি ক্ষতি পুরণের দাবি জানান। এছাড়াও এখনো সন্ত্রাসীদের হামলায় হতাহতের কোন সুষ্ঠ বিচার না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অধিকার বঞ্চিত পার্বত্য বাঙ্গালীদের সংগঠন পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ’র ৮ দফা দাবি যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি জোর দাবী জানান।

এতসবের পরও প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় না আনায় হতাশায় ভুগছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালীরা। এ ঘটনার বিচার নিয়ে নানা শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় পাহাড়ী-বাঙ্গালী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।