ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে এক ডজন কোম্পানি

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অবসরে যাওয়ার দুই মাসেও ওই পদে কাউকে নিয়োগ দিতে পারেনি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল)। শূন্য আছে ন্যাশনাল ও ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডির পদও। কাঙ্ক্ষিত কাউকে খুঁজে না পাওয়ায় ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়েই চলছে ব্যাংকগুলো। তবে ব্যাংকের চেয়েও নাজুক অবস্থা বীমা খাতের। অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো প্রধান নির্বাহীই নেই এ খাতের নয়টি প্রতিষ্ঠানে।

আর্থিক খাতের প্রধান নির্বাহী সংকট আগামীতে আরো বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ দুই বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন বিভিন্ন ব্যাংকের ডজনখানেক এমডি। আর বীমা শিল্পের সম্প্রসারণ হলেও গড়ে উঠছে না যোগ্য নেতৃত্ব। এছাড়া খাতটির প্রতি নতুনদের আগ্রহও তুলনামূলক কম।

ব্যাংকিং খাতে প্রধান নির্বাহী ও এমডিদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৫ বছর নির্ধারণ করে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী বয়সসীমা ৬৫ বছর অতিক্রম করায় চলতি বছরের ২ জানুয়ারি এসআইবিএলের এমডির পদ থেকে অবসর নেন মো. শফিকুর রহমান। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে থেকেই নতুন এমডি নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নেয় ব্যাংকটি। প্রাথমিক সম্মতির ভিত্তিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এমডি পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় এসআইবিএলের পরিচালনা পর্ষদ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিও নেয় এসআইবিএল। কিন্তু বেসকারি ওই ব্যাংকটি তাকে ছাড়তে না চাওয়ায় সব প্রক্রিয়া শেষ করেও এমডি পায়নি এসআইবিএল। দেড় মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়েই চলছে ব্যাংকটির কার্যক্রম। বর্তমানে ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল আজিজ।

ব্যাংক পরিচালনায় মতপার্থক্যের কারণে এ মাসের শুরুতে ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডির পদ ছেড়ে দিয়েছেন এএফএম শরিফুল ইসলাম। সেই থেকে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চলছে ন্যাশনাল ব্যাংকও। ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করছেন ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ।

পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তনের পর গত ৫ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। পরে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মো. আব্দুল হামিদ মিঞাকে এমডি পদে নিয়োগ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ফলে শূন্য রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি পদটি। সেই থেকে ইউনিয়ন ব্যাংকও চলছে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে। অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া বয়সসীমা শেষ হওয়ায় চলতি বছরের মে মাসেই অবসরে যাবেন ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আলী। প্রায় একই সময়ে অবসর নেবেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ মিঞাও। এর বাইরে দুই বছরের মধ্যে ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শেষ করবেন ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কাজী মশিহুর রহমান, মেঘনা ব্যাংকের মোহাম্মদ নূরুল আমিন, দ্য ফারমার্স ব্যাংকের কেএম শামীমসহ এক ডজনেরও বেশি এমডি। এতে ব্যাংকিং খাতে প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সংকট আরো তীব্র হবে বলে মনে করছেন ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরাই।

বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেন বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে শুধু দক্ষ প্রশাসক হলেই হয় না। বরং তাকে ক্রেডিট, লেন্ডিং, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ সব বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে হয়। সে হিসাবে সর্বগুণে গুণান্বিত লোকের আসলেই সংকট আছে। শতভাগ সত্য কথা হলো, ভালো এমডি পাওয়া মুশকিল। ব্যাংকের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশী খাতের ৪৭টি ব্যাংক কার্যক্রমে থাকার পরও ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া হয় আরো নয়টি ব্যাংক। সব মিলিয়ে এখন কার্যক্রম চালাচ্ছে তফসিলভুক্ত ৫৬টি ব্যাংক।

এসব ব্যাংক থেকেই যোগ্য নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠরা বিদায় নিলে নতুন নেতৃত্ব দাঁড়িয়ে যাবে।

কারণ অনেক ব্যাংকেই অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে একাধিক যোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন। ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান অবস্থায় নতুন যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠবেই। তবে দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। কারণ প্রত্যেক ব্যাংকই চায় যোগ্য কর্মকর্তাদের ধরে রাখতে।

একসময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগদানের সুযোগ থাকলেও সে অবস্থায় পরবর্তন এসেছে। গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সংঘটিত নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এসব ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণকারী শীর্ষ নির্বাহীদের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না বেসরকারি ব্যাংকগুলো। উল্টো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর অন্তরালে চলে গেছেন অনেকেই।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, আশির দশকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জনবল সংকট ছিল। সে সময় ব্যাংক পরিচালনা করার মতো অভিজ্ঞ জনবল বেসরকারি খাতে ছিল না। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা গিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের হাল ধরেছিলেন। বর্তমানে বেসরকারি খাতে যোগ্য জনবল তৈরি হয়েছে। তারা নিজেরাই এখন ব্যাংক পরিচালনায় স্বনির্ভর। তবে বড় আকারে না হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর যে ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে, তার একটা প্রভাব রয়েছে।

দেশে ৬১টি বীমা কোম্পানি কার্যক্রমে থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে নতুন করে অনুমোদন দেয়া হয় আরো ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে। এসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরুর পর বর্তমানে দেশে বীমা কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৭-এ। এর মধ্যে নয়টি কোম্পানিতেই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কোনো প্রধান নির্বাহী নেই। কোম্পানিগুলো হলো— আলফা লাইফ, জেনিথ লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, চার্টার্ড লাইফ, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ, ট্রাস্ট লাইফ, বায়রা লাইফ, ডেল্টা লাইফ ও ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স।

শুধু প্রধান নির্বাহীর সংকট নয়, খাতটির প্রতিটি বিভাগেই দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেন বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন। তিনি বলেন, বীমা খাত নিয়ে এমনিতেই মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব রয়েছে। তার ওপর কোম্পানিগুলোও উপযুক্ত বেতন-ভাতা দিতে চায় না। তাই বীমা খাতের প্রতি নতুনদের আগ্রহ অন্যান্য খাতের তুলনায় কম। তাছাড়া দক্ষ লোকবল গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চার বছর ধরে শূন্য আছে বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান নির্বাহীর পদটি। সর্বশেষ গত জুনে এ প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহীর পদে (চলতি দায়িত্বে) নিয়োগ পান সুশান্ত কুমার প্রামাণিক। তবে তাতে অনুমোদন নেই আইডিআরএর।

সুশান্ত কুমার প্রামাণিক বলেন, চার বছর ধরে এ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কাউকেই অনুমোদন দেয়নি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সর্বশেষ আমাকে নিয়োগ দিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। তবে আইডিআরএর অনুমোদন না পাওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে আমাকে বিরত থাকতে হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রধান নির্বাহী ছাড়াই চলছে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে এ প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পান শহিদুল ইসলাম। তবে তার এ নিয়োগেও অনুমোদন নেই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার।

শহিদুল ইসলাম বলেন, এর আগে বেশ কয়েকজন এ প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে তাদের পারফরম্যান্স ভালো না হওয়ায় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। আমার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে জানতে পেরেছি।

এক বছর ধরে প্রধান নির্বাহী পদে চলতি দায়িত্ব দিয়েই চলছিল ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। গত জুনে বোর্ডের অনুমোদনসাপেক্ষে প্রধান নির্বাহী পদে নিয়োগ পান মাহফুজুল বারী। সম্প্রতি পদটিতে তার অনুমোদনের জন্য আইডিআরএর কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে মাহফুজুল বারী বলেন, আমরা আবেদন করেছি। দেখা যাক কী হয়।

নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না থাকায় গত বছরের ডিসেম্বরে আইডিআরএর নির্দেশনামতো পদ ছেড়েছেন ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন পাটোয়ারী। অনুমোদন ছাড়াই চার বছর ধরে তাকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে বহাল রাখায় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যকে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ হারুন পাটোয়ারী বলেন, আমি গত ডিসেম্বরেই আইডিআরএর নির্দেশনামতো পদ ছেড়েছি। এখন ফজলে আলী চলতি দায়িত্বে রয়েছেন। তবে পুনরায় পদে যোগ দেয়ার জন্য আমি আইডিআরএর সঙ্গে আলোচনায় বসব।

উল্লেখ্য, বীমা খাতে প্রধান নির্বাহী নিয়োগ, নবায়ন ও অপসারণের বিষয়ে আইডিআরএর অনুমোদন নিতে হয়। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তির প্রধান নির্বাহী পদে যোগদান বীমা আইন, ২০১০-এর ৮০ ধারা এবং বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২-এর পরিপন্থী।

সূত্র: বণিকবার্তা।