ব্রাজিল প্রবাসীর এক দুঃখের গল্প `এই মাসে আমি আর টাকা পাঠাইতে পারুম না´

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ব্রাজিল প্রতিনিধিঃ বাংলেদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অন্যতম অবদান রাখে প্রবাসীরা। কিন্তু তারা  যেসকল দেশে অক্লান পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ যখন দেশ ও পরিবারের কাছে পাঠাতে কঠিন দায়ে সম্মুখিন হয় আবার নানা রকম ঝামেলা পোহাতে হয় তখন পরাজয়কে অনেকেই তখন মেনে নিতে বাধ্য হয়। তারা পড়ে যায় হতাশার সাগরে জর্জরিত।
এমন এক কাহিনী নিয়ে ব্রাজিল প্রবাসীর দুঃখের গল্প।

“আমার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে কিন্তু কর্ম ব্যস্থতায় এবং টাকার ব্যবস্থা করতে করতে কয়েক মাস পার হয়ে গেলো। অবশেষে গত মাসে যখন বাৎসরিক ছুটি পেলাম , পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম। আমার সাথে যুক্ত হলো আরো একজন , যিনি ঠিক মতো এখানকার ভাষা জানেন না , এমনকি ঠিক মতো চোখে ও দেখতে পারেন না। পেলাম আরো কয়েকটি ফোন, যাতে তাদের পাসপোর্টের খোঁজখবর নিয়ে আসি। আর একজন দিলেন তার পুরাতন পাসপোর্ট, ফর্ম এবং টাকা, তার নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে।

দুপুর সাড়ে ৩টায় বাসে উঠলাম সাও পাওলো শহর থেকে , পরবর্তী দিন সকাল ৭ টায় ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে পৌঁছিয়েছিলাম। সাড়া রাত ঠিক মতো ঘুম নেই, এমন কি ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া ও করতে পারিনি। আমাদের ধর্মীয় এবং সংস্কৃতিগত কারণে এখানকার অনেক গুলো খাবার আমরা খেতে পারি না।  যেমন: বেকন; লিঙ্গুইছা ;প্রেজুনতু ইত্যাদি, এগুলু তৈরী হয় শুয়োর থেকে।  সবচেয়ে বিরক্তকর বিষয়টি হচ্ছে, যে সব খাবার গুলো সহজেই সব জায়গায় পাওয়া , এর বেশিরভাগ খাবারের মাঝেই এই গুলো ব্যবহার হয়ে থাকে। যাই হউক, সকালে পৌঁছে দেখি বেশিরভাগ দোকান গুলো তখনও খুলেনি। না খেয়েই  ট্রেন স্টেশনের দিকে যাত্রা করলাম। ট্রেনে করে সেন্ট্রাল বাস টার্মিনালে পৌছিয়ে পেলাম কয়েকটি স্ন্যাক বার খোলা। যে খাবারটি আমরা সচরাচর খেয়ে থাকি তাই আমি নিলাম এবং তার সাথে ফ্রেশ আখের রস। খাবার শেষ করেই বাসে করে চলে গেলাম ব্রাজিলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে। মনে হচ্ছিলো নিজের দেশে যাচ্ছি।

হাঁটতে হাঁটতে যখন দেখতে পেলাম বাংলাদেশ দূতাবাস লেখা, কেমন জানি একটি অনুভূতি অনুভব হয়েছিল। নিজের দেশের নামটি যখন দেশের বাহিরে দেখি কি সেই অনুভূতি হয়, তা শুধু যাহারা প্রবাসে আছেন তাদেরই শুধু বোধগম্য হবে। দূতাবাসে পৌঁছানোর পর যিনি আমাদের জন্য গেট খুলে দিয়েছিলেন তিনি ব্রাজিলস্থ বাংলাদেশিদের কাছে একটি পরিচিত নাম। তাকে সবাই সেন্টু ভাই বলে ডাকে।

গিয়ে পেলাম প্যারাগুয়ে থেকে আসা রবিন সাহেবকে তিনি একদিন আগে থেকেই ব্রাসিলিয়াতে। এসেছিলেন অনেকের পাসপোর্ট এবং নো ভিসা সংক্রান্ত কাজ নিয়ে ।  ফরম পূরণ করে জমা দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমার সিরিয়ালের জন্য, তারই মধ্যে ধীরে ধীরে আরো অনেকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসে পৌঁছেছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে কেউ এসেছেন পারানা থেকে, কেউ এসেছেন সাও পাউলো থেকে। দুজন এসেছেন পারানার এমন প্রান্ত থেকে, দুদিনের ও বেশি লেগেছে বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌঁছাতে। এদিকে প্যারাগুয়ে থেকে আসা রবিন সাহেবের ফিরে যাওয়ার ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে কিন্তু উনার কাজ এখনো ও শেষ হয়নি। উনি খুবই উদ্বিগ্ন , কেননা ফ্লাইট টি ধরতে না পারলে প্রায় ৪০ হাজার টাকা নষ্ট হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত তার কাজটি সমাধান করা হয়েছে।যারা দেরিতে এসে পৌঁছেছেন , খুবই উদ্বিগ্নতার সাথে সময় কাটাচ্ছিলেন, কেননা কাজটি দিনের মধ্যে শেষ করতে না পারলে , একদিন বেশি থাকতে হবে যা কাজের জন্যও সমস্যা এবং খরচের ও পার।

দুপুরের খাবারের পর আমার কাছে দেওয়া কাজ গুলো নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম এবং দেখিয়েছিলাম যে, তারা আমাকে লিখিত ভাবে ক্ষমতা প্রদান করেছে তাদের কাজের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, কিন্তু আমার কাছে দেওয়া কাজ গুলো গ্রহণ করা হয়নি। কারণ হিসেবে বললেন , আমরা এভাবে পূর্বে আপনাদের অনেক কাজ করে দিয়েছি। এ নিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে , আমরা টাকা নিয়ে এগুলো করেছি , যা আমাদের মানকে ক্ষুন্ন করেছে । এর পর থেকে আমরা নিয়ম করেছি যে , যার কাজ তাকে স্বশরীরে এসে জমা দিতে হবে এবং এসে গ্রহণ করতে হবে। আমি আমার কাজ শেষ করে , সাথের লোকটিকে নিয়ে চলে গেলাম বাস টার্মিনালে।  গিয়ে দেখি বিকালের সব বাস গুলো চলে গিয়েছে, শুধু রয়েছে রাতের বাস গুলো। সবগুলো ভাড়া যাচাই করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নরমাল এ  যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম। নরমালের ভাড়া ছিল ব্রাজিলের মুদ্রায় ২৬০ , শোয়ে যাওয়ার ভাড়া ছিল তার চেয়ে ও বেশি। সারা রাত , সকাল শেষে দুপুর ঘনিয়ে সাড়ে ৩ টায় সাও পাউলো শহরে পৌছিয়েছিলাম।

যারা জানতেন যে আমি বাংলাদেশের দূতাবাসে গিয়েছিলাম, উনারা সবাই ফোন করতে ছিলেন বিভিন্ন কিছু জানার জন্য। যেমন: কিভাবে যেতে হয়,কত টাকা খরচ হয়, কতক্ষন সময় লাগবে ইত্যাদি। তার কয়েকদিন পর একজন বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েছিলেন নতুন পাসপোর্টের জন্য , ফিরে এসে বিষন্ন হয়ে বলতেছিলেন, “এই মাসে আমি আর টাকা পাঠাইতে পারুম না´´।

যেখানে ব্রাজিলের আইন অনুযায়ী যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ক্ষমতা প্রদান করা যায় তার পক্ষ হয়ে কাজ করার জন্য অথবা কোনো পেশাধারী কোম্পানিকে নিয়োগ করা যায়।  এখানে অন্যান্য দূতাবাস গুলো কুরিয়ারের মাদ্ধমে দূরবর্তীস্থানে বসবাসকারীদের সেবা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ দূতাবাসেও এ সেবাটি চালু ছিল, আমি নিজেও এ সেবাটি পেয়েছিলাম। কান কথার উপর ভিত্তি করে একটি প্রচলিত সেবা, যার মাদ্ধমে মানুষ উপকৃত হচ্ছিলো তা বন্ধ করে দেয়া, কতটুকু যুক্তি সঙ্গত ?

আমি যেই শহরে আছি, সেই শহর থেকে যদি কাউকে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হয়, তাহলে  তাকে তিনদিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি নিতে হবে। দুইরাত বাসে ঘুমাতে হবে, খাওয়া-দাওয়া এবং গোসল হয়ে যাবে দুর্বিষহ , এবং তাকে সর্বনিম্ন খরচ করতে হবে বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় ১৬৩৮০ টাকা। আবার যখন আনতে যেতে হবে, আবার ১৬৩৮০ টাকা এবং পাসপোর্ট ফি প্রায় ৯৮৮০ টাকা। একটি পাসপোর্ট করতে প্রায় সর্বমোট ৪২৬৪০ টাকা এবং ছয়দিন কাজ থেকে ছুটি নেয়া। ব্রাজিল একটি অনেক বড় দেশ, এমন ও প্রান্ত আছে যেখান থেকে গিয়ে পাসপোর্ট করাতে খরচ হতে পারে ১ লক্ষ টাকার মত।

তাদের এই পরিশ্রমের উপার্জন গুলো বাংলাদেশের অনেকগুলো পরিবারের প্রদান চালিকা শক্তি এবং যা আমাদের দেশের অৰ্থনীতি উন্নয়নে কিছু হলেও ভূমিকা রাখে। এখানে প্রায় ৫০০০ বাংলাদেশী বসবাস করেন, তাদেরকে বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হয়। বাংলাদেশের এই দূতাবাসটি দক্ষিণ এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার একমাত্র দূতাবাস। সেহেতু, এই দূতাবাসের ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

মাননীয় কর্তৃপক্ষ আপনার ফিরে দেখার অপেক্ষায়, অনেকগুলো মানুষ সেবা থেকে এবং অনেকগুলো  পরিবার কত গুলো টাকা থেকে বঞ্চিত। ব্রাজিলস্থ বাংলাদেশী প্রবাসীরা এই বিষয়টির প্রতি আপনাদের ফিরে দেখার প্রত্যাশা করছে।”

লেখক : ডাঃ মোহাম্মদ ফ এ হাসান

সভাপতি এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য , বাংলাদেশ কমিউনিটি ব্রাজিল (CBB)