বিহারী ঝনুর জন্য শাবানার আক্ষেপ!

সদ্য প্রয়াত জয়নুল আবেদিন একাধারে ভাষা সৈনিক, চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক পরিচয়ের দ্যুতি ছড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশের বাইরে। পাশাপাশি মৃত্যুর এ খবরে আবেগ তাড়িত হয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন খ্যাতিমান অভিনেত্রী শাবানা।

আহমেদ তেপান্তর: ‘কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিখ্যাত উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এ সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের পর আর কিছু নয় চেয়েছিলেন একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট। বিহারী ঝনু নামে পরিচিত জয়নাল বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর লিখিত নির্দেশে’ – এমনটাই জানিয়েছেন বিশিষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমান।

বিহারী ঝনুর জন্য শাবানার আক্ষেপ!
সদ্য প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক জয়নুল আবেদিন। ছবি : সংগৃহিত।

সদ্য প্রয়াত জয়নুল আবেদিন একাধারে ভাষা সৈনিক, চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক পরিচয়ের দ্যুতি ছড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশের বাইরে। পাশাপাশি মৃত্যুর এ খবরে আবেগ তাড়িত হয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন খ্যাতিমান অভিনেত্রী শাবানা।

গত শুক্রবার আবেদিনের মৃত্যুর খবরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী শাবান আবেগআপ্লুত হয়ে ফোন দেন পরিচালক আজিজুর রহমানের কাছে। আবেদিনের বিষয় শাবানার স্মৃতিচারণার কথা উল্লেখ করে খ্যাতিমান এই পরিচালক বলেন, ‘‘জয়নুল আবেদিনের মধ্যে যে দেশপ্রেম দেখেছি বিশেষ করে তিনি আমাদের শিল্পীদের খুবই সম্মানের চোখে দেখতেন, যা এখন অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত। দেশের এবং চলচ্চিত্রে তার অবদানকে শ্রদ্ধা জানাই। ভালো লাগতো জীবদ্দাশায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যদি পেত।’

বিহারী ঝনুর জন্য শাবানার আক্ষেপ!
পরিচালক আজিজুর রহমান।

নিজে উর্দুভাষী হয়েও যিনি বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছিলেন সোচ্চার, বাংলাদেশের টানে এখানে থেকে গেছেন স্বজনদের ছেড়ে। মৃত্যুরপূর্বে সাংবাদিক লিটন আরশাদের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে  জয়নাল আবেদীন বলেছিলেন, “ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তখন ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস ছিলো ফুলবাড়িয়ায়। বামপন্থি রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে দেয়াল লিখনে হাত পাকিয়েছিলেন তিনি তখনই; ঘনিষ্ঠরা তাকে বলতেন- ‘মাস্টার অব ওয়াল রাইটার’।”

তিনি বলেন, ‘ভাষার জন্য এরকম রক্ত দেয়ার ঘটনা বিশ্বে আর কখনও ঘটবে না। এজন্যই সারাবিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিলম্বে হলেও স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই রকম একটি দেশের মানুষের সঙ্গী আমি, এটাই আমার বড় ভাগ্য।’

এদিকে প্রবীণ এই সাংবাদিকের মৃত্যুতে প্রকৃত অর্থে একজন উদার এবং সাহসী বীর পুরুষকেই রাষ্ট্র হারিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন সাংবাদিক নেতা মুহম্মদ আব্দুল্লাহ, অনুপম হায়াৎ, চিন্ময় মুৎসুদ্দী, কুদ্দুছ আফ্রাদ, কাদের গণি চৌধুরী, জুটন চৌধুরী,

বিহারী ঝনুর জন্য শাবানার আক্ষেপ!
অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ।

লিটন আরশাদ, কাফি কামাল প্রমুখ। তারা বলেন, ‘বিহারী ঝনু ভাই আমাদের শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময় আমরা তাকে কিছুই দিতে পারিনি।’ এছাড়া, পরিচালক সি বি জামান, অভিনেতা ফারুক, সোহেল রানা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, চিত্রনায়িকা ববিতা, অঞ্জনা, রোজিনা, অরুণা বিশ্বাস, মুনমুন গভীরভাবে প্রয়াত এই সাংবাদিকের প্রতি তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

বিহারী ঝনুর জন্য শাবানার আক্ষেপ!
ববিতা।

আসাদ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সম্মাননার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কিছুই হলো না। এটা ভেবে খারাপ লাগে; তিনি কেবল দিয়েই গেলেন আর আমরা অকৃতজ্ঞর মতো হাত পেতে নিলাম।’

ববিতা বলেন, ‘ঝনু ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাদের ‘তুই’ করে সম্বোধন করতেন। অনেক কিছুই পত্রিকায় সমালোচনার বদলে সরাসরি বলতেন। শিল্পীদের প্রতি তার সহানুভূতিসুলভ আচরণের জন্য আমি বিশ্বাস করি সিনিয়রা তাকে মনে রাখবে।’

‘আর রাষ্ট্রের প্রতি তার যে অবদান সেটার ব্যাপারে রাষ্ট্রকেই ভাবতে হবে, আমি কেবল আমার অবস্থান থেকে বলতে পারি একজন দেশপ্রেমিক নির্লোভ ঝনু ভাই আর আসবে না’- যোগ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই অভিনেত্রী।

জয়নাল আবেদীনের জন্ম ১৯৩৭ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী এলাহাবাদে; শৈশব কেটেছে বিহারে, যেখানে তার বাবা মুহাম্মদ মোস্তফা ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হেড ড্রাফটসম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দেশ বিভাগের পর মোস্তফা পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে যোগ দেন, কর্মস্থল হয় বর্তমান নীলফামারীর সৈয়দপুরে। সেই সুবাদে সৈয়দপুরের হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে আইকম ও বিকম পাস করেন জয়নাল আবেদীন। কলেজে থাকার সময় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন তিনি।

সাংবাদিকতা জীবন শুরুটা ১৯৫৭ সালে উর্দু দৈনিক জংয়ের মাধ্যমে। পরে তিনি মর্নিং নিউজ, বাংলাদেশ টাইমস, অধুনালুপ্ত চিত্রালী, পাকিস্তানভিত্তিক ওয়াতন, সংবাদ সংস্থা এনায় কাজ করেছেন জাতীয় প্রেসক্লাব ও বাচসাস এর জীবিত একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা জয়নুল।

এহতেশামের ‘চকোরী’সহ (সংলাপ) একশর বেশি চলচ্চিত্র কাহিনীর রচয়িতা চিরকুকুমার জয়নুল আবেদীন। এহতেশাম ছাড়াও কাজ করেছেন, মুস্তাফিজ, শিবলী সাদিক, রহমানের সঙ্গে।

১৯৫০ সাল থেকে জয়নাল আবেদীন ঢাকায় বসবাস করছেন। তার ঠিকানা তোপখানা রোডের জাতীয় প্রেস ক্লাব।তবে একটি সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি থাকার জন্য বরাদ্দ পেয়েছিলেন, সেই বাড়িটি পরে দখল হয়ে গেলে পুনরায় ফিরে আসেন তোপখানা রোডের জাতীয় প্রেসক্লাবে। পাসপোর্টেও এই ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে।

উল্লেখ্য, নিভৃতচারী এই সাংবাদিক ৮১ বছর বয়সে যকৃতের জটিলতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যায়  হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ মার্চ না ফেরার দেশে চলে যান। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।