পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হচ্ছে জুলাইতে

পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হচ্ছে জুলাইতে। এলক্ষ্যে ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়েছে। ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলার পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়া হয়েছে ২৪ জুলাই। এরপরই এই দু’পিলারের উপরে প্রথম স্প্যানটি বসিয়ে দেয়া হবে। ইতোমধ্যেই লোড টেস্ট করে স্থাপনের জন্য প্রস্তুত রাখা প্রথম স্প্যানটি (১৫০ মিটার দীর্ঘ সুপার স্ট্রাকচার) বসিয়ে দেয়া হবে এই পিলারের উপর। এটি স্থাপানের পরই সেতুর মূল চেহারার অংশ ভেসে উঠবে।
এরপর ধীরে ধীরে আরও ৪০টি স্প্যান বসবে। এর আগে প্রথম স্প্যানটি স্থাপণের ঘোষণা ছিল গত জানুয়ারিতে। কিন্তু নানা চ্যালেঞ্জের কারণে তা সম্ভব হয়নি।
পদ্মায় সেতুর বেইজ গ্রাউন্ড সমস্যার সমাধানের পরই কর্মযজ্ঞে নতুন সম্ভবনা উকি দিয়েছে। পদ্মা সেতুর দায়িত্বশীল এক প্রকৌশলী তথ্যটি নিশ্চিত করে জানান, প্রবল স্রোতের বৈচিত্র্যময় পদ্মার তলদেশের মাটিতেও নানা বৈচিত্র্যতা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই বিশ্বের প্রথম এই ব্যতিক্রম এবং বেশি গভীরে পিলার স্থাপন করে তৈরি করা হচ্ছে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আরেক ধাপ অতিক্রম করছে।
এদিকে পদ্মা সেতুর বেইজ গ্রাউন্ড সমস্যার সমাধান দিয়ে বিদেশী ১২ বিশেষজ্ঞ ফিরে গেছেন। পদ্মায় সেতুর পাইলের বেইজ গ্রাউন্ড কংক্রিটিংয়ে চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। তাই বিদেশী ১২ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তলব করে চীনা ঠিকদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানী। এখন এই সমস্যা সমাধানের পর পুরোদমে পাইলের কাজ চলছে। ৩৭ নম্বর পিলারের দু’টি পাইলে কংক্রিটিং চলছে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আব্দুল কাদের জানান, এই ৩৭ নম্বর পিলার ও ৩৮ নম্বর লিারের উপরই বসবে প্রথম স্প্যান। প্রতিটি স্প্যানের ওজন প্রায় ২৯শ’ টন। আর এই স্প্যান বহনের জন্য দেশের সবচেয়ে বেশি ৩৬শ’ টন ক্ষমতার ভাসমান ক্রেন প্রকল্প এলাকায় অপেক্ষায় রয়েছে।
এ পর্যন্ত মূল সেতুর বটম পাইল হয়েছে ৪৬টি। গত শনিবার আরও একিট সম্পন্ন বসানো হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি পাইলের টপ সেকশন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ৩৭ নম্বর পিলারে ২টি পাইল কংক্রিটিংয়ের কাজ চলছে। জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের পাইল স্থাপানে হাফ সেঞ্চুরী অতিক্রম করেছে। এই সংযোগ সেতুর ৫৫টি পাইলেরই কংক্রিটিং শেষ হয়ে গেছে। পুরোদমে এখানে কাজ চলছে। এখন কাজের এই গতি মাওয়া প্রান্তেও ছড়িয়ে দিতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। মাওয়া প্রান্তে ভায়াডাক্টের (সংযোগ সেতু) পাইল স্থাপন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মাওয়া প্রান্তের নদীতে ৪ ও ৫ নম্বর পিলারের বটম সেকশন পাইল স্থাপানের সরঞ্জামাদি সেট করা হয়েছে। শিঘ্রই এর ড্রাইভও শুরু হচ্ছে। এর আগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে ৩টি করে পাইলের বটম সেকশন সম্পন্ন করে স্রোতের কারণে এই পাইলের কাজ জাজিরা অংশে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল গত বর্ষার আগে। প্রথম পিলার (ট্রানজেকসন পিলার) মাওয়া প্রান্তে ১ নম্বর পিলারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডিজাইন চূড়ান্ত হয়েছে। ৪২ নম্বর পিলারের মত এই পিলারেও শিঘ্রই এই ট্রানজেকসন পিলারটির কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
চার স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ হাজার :
এদিকে পদ্মা সেতুর পুনর্বাসন স্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। চারটি স্কুলেই একযোগে বুধবার সকাল ৯টায় ক্লাস চালু শুরু হয়। চারজন প্রধান শিক্ষক ২৪ জন শিক্ষক প্রথম দিনেই শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেন। চার স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
স্কুলগুলোর এই শুভযাত্রায় অংশ নেন পদ্মা সেতুর ডেপুটি প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান সাইদুল হাসান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুনর্বাসন) ফরিদুল আলম, উপ-পরিচালক ভিখারুদ্দৌলাহ চৌধুরী, নির্বাহী প্রকৌশলী (পুনর্বাসন) মো. তোফাজ্জল হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী (নদী শাসন) সারফুল ইসলাম, লৌহজং উপজেলার ইউএনও মো. মনির হোসেন ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রমুখ। স্কুলগুলো চালু হওয়ার পর শিশুদের কলকাকলীতে বিশেষ পরিবেশ পুনর্বাসনের স্কুলগুলোতে। আর পরিকল্পিত এবং আধুনিক নানা সুবিধা-সম্বলিত পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে এখন প্রাণের স্পন্দন।
‘পদ্মা সেতু পুনর্বাসন প্রাথমিক বিদ্যালয়’ -নামে লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্র, যশলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং মাদারীপুরের শীবচর উপজেলার বাকরেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্র ও শরীয়তপুরের নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে এই চার স্কুল। এই স্কুলে পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসবাসরত পরিবারের শিশু ছাড়াও আশপাশ এলাকার শিশুরা এই স্কুলে ক্লাস করেছে প্রথম দিনেই। শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ‘রিক’ নামের একটি এনজিও’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগসহ অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করছে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (পুনর্বাসন) মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, এই চার স্কুল চালু ছাড়াও পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঁচটি হাসপাতাল চালু হচ্ছে শিঘ্রই। পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্যই এগুলো চালু করা হচ্ছে। তিনি জানান, এনজিও ‘রিক’ এই পাঁচটি হাসপাতালের স্বাস্থ্য উপকরণ-সরঞ্চামাদি এবং চিকিৎসক নিয়োগের কাজ করছে। এই পাঁচটি হাসপাতাল চালু হচ্ছে- মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ও যশলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে, মাদারীপুরের শীবচরের বাখরেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্র, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা পুনর্বাসন ও পশ্চিম নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পূর্ব ও পশ্চিম নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্র মিলে একটি স্কুল করা হলেও হাপাতাল করা হয়েছে দু’টি। এই পাঁচ পুনর্বাসন কেন্দ্রের ২৭শ’ প্লটের মধ্যে ইতোমধ্যে ২ হাজার ২৬২টি প্লট বরাদ্দ হয়ে গেছে। বাকী প্লটগুলোর বরাদ্দ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পরিবারগুলোর বসবাসের পর নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এখানে। পদ্মা সেতু তৈরি ছাড়াও এই প্রকল্পের আওতায় এমন নানা কিছু করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিগত সচিব সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই স্কুল এবং হাসপাতালগুলো এখন পদ্মা সেতুর প্রকল্পের টাকায় চলছেও ভবিষ্যতে এগুলো জাতীয়করণ করা হবে।
২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতুটি চার লেনবিশিষ্ট। মূল সেতুটি দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২২ মিটার। সেতুটিতে মোট ৪১টি ¯প্যান (অংশ) থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ¯প্যান বড় হওয়ার কারণে রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিক¤পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেওয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। পুরো সেতুটির ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২টি পিয়ার (পিলার), যা মাঝের ৪০ পিলারের প্রতিটির নিচে থাকছে ৬টি পাইল। এই সেতু বাংলাদেশের ভাগ্য বদলে দেবে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যেই সব মিলিয়ে গড়ে সেতুটির প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে।