বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ
প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এ ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। এই ইতিহাস বাংলাদেশের অনেকেরই জানা।
কিন্তু এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরো অনেক সংগ্রামের ইতিহাস।
ভাষা থেকে যেভাবে আন্দোলনের সূচনা
যখন ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক।
ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ‘ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য’ বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ।’
এই বইটির বর্ণনা অনুযায়ী দেশভাগের আগেই চল্লিশের দশকের শুরুতেই সাহিত্যিকরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন।
ওই বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বাংলা, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি এ চারটি ভাষার পক্ষ-বিপক্ষে নানান মত ছিল।
আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। …এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই এবং বাঙালি মুসলমানের সেকুলার জাতীয়তাবোধ এর পেছনে কাজ করেছে।’
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ওই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকতে পারে না।’
দৈনিক আজাদি পত্রিকায় ১৯৪৭ সালে লেখক সাংবাদিক আবদুল হক লিখেছিলেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সাথে সাথে প্রত্যেক উর্দু-শিক্ষিতই চাকরির যোগ্যতা লাভ করবে এবং প্রত্যেক বাংলাভাষীই চাকরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে।’
বাংলাভাষীদের আরো উদ্বেগ ছিল দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে। শুধু ধর্ম তাদের মধ্যে কতটুক যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবে তা নিয়ে ভাবনা ছিল অনেকের।
অবিশ্বাসের বীজ বপন
১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। তখন ভাষা নিয়ে বিতর্ক আবারো জেগে উঠেছিল। ততদিনে মুসলিম বাঙালীদের আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
দেশ বিভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এ ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কমিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন।
পাকিস্তান গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পরে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই এসব ছাপা হয়ে গেছে।’
যদিও তার এই বক্তব্য সবাই গ্রহণ করেনি।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন
ওই সময় বুদ্ধিজীবীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে মাতৃভাষার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দিলে বাংলাভাষী পরের প্রজন্ম অশিক্ষিত হয়ে পড়বে, বাংলা ভাষার সত্ত্বা ঝুঁকিতে পরবে। স্বাধীনভাবে মাতৃভাষার চর্চার ক্ষেত্রে এটিকে বড় আঘাত বলে মনে করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে বাঙালির মনে ক্ষোভের অনুভূতি তখন থেকেই দানা বাধতে থাকে। ওই বছরের শেষের দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়।
তখনকার একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের নূরুল হক ভূঁইয়া, তৎকালীন সংসদ সদস্য সামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা অলি আহাদ, পরে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অনেকেই এর সদস্য ছিলেন, যারা শুরুতে গোপনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।
জিন্নাহ ও তার অনমনীয় অবস্থান
ওই সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।
ওই সমাবেশে উপস্থিত অনেকেই সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠে। এই ঘোষণাকে বলা যেতে পারে নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের সূচনা।
জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে শুরু থেকে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে বাঙালিদের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম করা এবং শোষণের অভিসন্ধি বলে মনে করা হয়েছিল। বাঙালিদের মনে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বাসের ভীত তৈরি হয়েছিল। ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য আরো জোরালোভাবে প্রতীয়মান হচ্ছিল।
ধর্ম নয় বরং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল।
অন্য দিকে তখনকার উর্দুভাষীরা বাঙালির সংস্কৃতিকে ’হিন্দুয়ানী’ বলে মনে করাটা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের বিতৃষ্ণার আরেকটি কারণ।
ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম
জিন্নাহর মৃত্যুর পরো রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নানা রকম প্রস্তাব, পাল্টা প্রস্তাব চলতে থাকে। দেশভাগের পর থেকে ১৯৫২ সালের শুরু পর্যন্ত বাঙালিরা জোরালোভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধ মনোভাব ব্যক্ত করে গেছেন।
প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে আন্দোলন চলেছে।
তবে এ আন্দোলনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয় যখন ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ববঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহর কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। তাতেও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে যা ঘটেছিল
বলা হয়ে থাকে রাজনৈতিক কারণে নেয়া খাজা নাজিমুদ্দিনের অবস্থান ও তার বক্তব্য ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। তার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে বঞ্চনার অনুভূতি আরো জোরালো হয়ে জেগে ওঠে।
খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে পরের দিন থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল। যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ভাসানীর নেতৃত্বে সম্মেলনে অংশ নেয় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সংস্কৃতিকর্মী ও পেশাজীবী সম্প্রদায়ের মানুষজন।
একুশে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। যা লঙ্ঘন করেই জন্ম হয়েছিল শহীদ দিবসের।
ওই দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত ছিলেন মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। কয়েক বছর আগে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে ওই দিনের চিত্র।
সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালে গ্রহণ করি আমি। কপালে গুলিবিদ্ধ রফিককে দেখেই মৃত ঘোষণা করা হয়, আর উরুতে গুলিবিদ্ধ বরকত মারা যান রাতে, আমার চোখের সামনেই।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছেই গুলিবর্ষণ হয়েছিল শিক্ষার্থীদের ওপর।
তিনি বলছিলেন, ‘আমরা তখন বাইরে থেকে বহু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা শুনেছিলাম বহু মানুষ গুলিতে আহত হয়েছে। মুহূর্তেই এমারজেন্সি ওয়ার্ড পূর্ণ হয়ে যায়। আহতদের অনেকেই মুমূর্ষু, তাদের সাথে আসা মানুষজন আর চিকিৎসকে ঠাসাঠাসি হয়ে যায় জরুরি বিভাগ।’
ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না।
ওই এবং পরে দিন পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরো অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বীজ বপন
এ হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি। এ আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে ২০০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনে এক হওয়ার অনুভূতি সম্ভবত জাগ্রত হবে না।
তবে এই ঘটনার দু’বছরেরও বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরো দু’বছর।
মাতৃভাষা নিয়ে এ আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
সূত্র : বিবিসি
বিডিসংবাদ/এএইচএস