বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ
ভারতের ২৮টি অঙ্গরাজ্যে যে মুখ্যমন্ত্রীরা আছেন, তাদের কারো বায়োডাটা এতটা বর্ণময় নয় তা চোখ বুজে বলা যায়। তিনি শুধু প্রথাগত রাজনীতিবিদ নন, সাবেক একজন গেরিলা যোদ্ধাও বটে!
আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও নির্মেদ, টানটান চেহারা, রোজ নিয়ম করে ঘাম ঝরিয়ে দেড়-দু’ঘণ্টা ব্যাডমিন্টন খেলেন আজও।
এক সময় ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন জঙ্গলে পর্যন্ত কাটিয়েছেন বছরের পর বছর।
আবার পরবর্তী জীবনে তিনিই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে এসেছেন, ভারতের দূত হিসেবে নানা দেশে নানা গোপন মিশনেও অংশ নিয়েছেন।
বহু উগ্র ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনায় তাকে মধ্যস্থতা দেখা গেছে। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো আবার পর্দার আড়ালে।
যার কথা বলছি, তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামের তিন-তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা।
মিজোরামে ক্ষমতাসীন দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সর্বোচ্চ নেতা তথা প্রেসিডেন্টও তিনি। আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগে বিজেপির নেতৃত্বে যে এনডিএ জোট গড়ে তোলা হয়েছিল, একেবারে শুরু থেকে সেই এনডিএ-রও শরিক তার দল।
বিবিসি বাংলাকে গত বছর দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তথা নরেন্দ্র মোদির ডান হাত অজিত ডোভালের সঙ্গে মিলে বহুবার তিনি গোপনে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে গেছেন।
সে সব দেশে সক্রিয় বিভিন্ন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টাও চালানো হয়েছে ওই সব অভিযানে।
এমন কী প্রতিবেশী বাংলাদেশেও পুরনো সুসম্পর্কের সুবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া- দু’জনের সঙ্গেই সরাসরি টেলিফোন তুলে কথা বলার ক্ষমতা রাখেন তিনি। বলেছেনও বহুবার। এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চোখ বন্ধ করে দেশের হাতেগানা যে কয়েকজন রাজনীতিবিদকে ভরসা করেন বলে শোনা যায় – জোরামথাঙ্গা তাদেরও অন্যতম।
অথচ গত কয়েকদিন ধরে সেই জোরামথাঙ্গার গলাতেই শোনা যাচ্ছে ভিন্ন সুর। নানা ইস্যুতে তিনি মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন, প্রকাশ্যে সমালোচনা পর্যন্ত করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
মণিপুর পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে ওই রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের সঙ্গে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বেও জড়িয়ে পড়েছেন তিনি।
মিজো রাজনীতির এই প্রবাদপ্রতিম নেতাকে নিয়ে ভারতের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে চর্চাও হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।
আগামী দিনে তিনি কোন দিকে ঝুঁকতে পারেন, বিজেপির সঙ্গ ছাড়বেন কি না– তা নিয়ে জল্পনাও হচ্ছে বিস্তর।
গত রোববারও (৩০ জুলাই) তিনি বেশ হাসতে হাসতেই বিবিসির এই প্রতিবেদককে টেলিফোনে বললেন, ‘দেখা যাক, সামনে কী হয়। আর কী করব তা তো আপনারা দেখতেই পাবেন!’
ডোভালের সঙ্গে জুটি বেঁধে
বিগত প্রায় এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে যিনি দেশে-বিদেশে সরকারের প্রধান ‘ট্রাবলশ্যুটার’ হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি হলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সাবেক গোয়েন্দা-প্রধান অজিত ডোভাল।
সেই অজিত ডোভালের সঙ্গে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গার ব্যক্তিগত সমীকরণ খুবই ভালো। আর তারা দু’জনে একই সঙ্গে বহু ‘মিশনে’ও গেছেন।
গত আগস্ট মাসে মিজোরামের রাজধানী আইজলে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জোরামথাঙ্গা বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে শান্তি ফেরানোটা যে কত জরুরি, সেটা বুঝেই আমি আর ডোভাল একসঙ্গে ওই অভিযানে নেমেছিলাম।’
২০১৮ থেকে ২০২০’র মধ্যে বিমানবাহিনীর বিশেষ এয়ারক্র্যাফটে চেপে তারা মিয়ানমারের ভেতরে বহু ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ গোষ্ঠীর ডেরাতেও গিয়েছিলেন, সে দেশের সরকারের সম্মতি নিয়েই।
‘আমরা জানি মিয়ানমারের কাচিন, কারেন, শান, আরাকান, চিন হিলস সর্বত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীদের সঙ্গে সেনার সংঘর্ষ চলছে, আর তার কোনো কোনোটার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ভারতেও।’
‘তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যাতে সরকারের সাথে আলোচনার টেবিলে বসানো যায়, সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। আর আমরা নিগোশিয়েশন করছিলাম মূলত কাচিন আর চিনদের সঙ্গে’, সে দিন বলেছিলেন জোরামথাঙ্গা।
নেপিদওতে, না হলে ব্যাঙ্ককে বা দিল্লিতে যাতে এই শান্তি বৈঠক হতে পারে – তার জন্যও কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের দিল্লি সফরও প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান সেই সব হিসেব-নিকেশই উল্টে দেয়। শান্তি-আলোচনার উদ্যোগ ভেস্তে যায়, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর দমন-পীড়ন শুরু হয়ে যায়।
‘দেখুন, নিজে যেহেতু বহুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন কাটিয়েছি, তাই এদের সঙ্কটটা, এদের চাওয়া-পাওয়াটা আমি বুঝি।’
‘আর তারা তো স্বাধীন রাষ্ট্র চাচ্ছেন না, মিয়ানমারের ভেতরেই একটা ফেডারেল কাঠামো চাচ্ছেন– তাতে অসুবিধা কোথায়?’, বেশ আক্ষেপের সুরেই সে দিন বলেছিলেন জোরামথাঙ্গা।
পরে মিয়ানমারের চীন স্টেটে সেনা নির্যাতনের জেরেই ওই প্রদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার শরণার্থী গত আড়াই বছরে মিজোরামে এসেছেন আর তাদের শরণার্থীর মর্যাদা দেয়া নিয়েই মোদি সরকারের সাথে জোরামথাঙ্গার প্রথম সঙ্ঘাত শুরু হয়।
বাংলাদেশ যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা
২০২১ সালের গোড়ায় যখন মিয়ানমার থেকে মিজোরামে শরণার্থীর ঢল নামে, জোরামথাঙ্গার সরকার তাদের সাদরে স্বাগত জানিয়েছিলে।
রাজ্যের মিজো’রা মিয়ানমার থেকে আসা তাদের চীন ভাইবোনদের মাথার ওপর ছাদ, দুই বেলার খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছিল। রাজ্যের নানা প্রান্তে রাতারাতি গড়ে তোলা হয়েছিল অজস্র শরণার্থী শিবির।
জোরামথাঙ্গা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আমাকে প্রথম দিন থেকেই হোম মিনিস্ট্রি বলে আসছে এদের পুশব্যাক করো। আমি সোজা বলে দিয়েছি এদের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক, আমি কিছুতেই তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারব না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে জোরামথাঙ্গার সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে তারপর থেকেই।
‘আমি অমিত শাহকে এমনও বলেছিলাম, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনার নির্যাতন থেকে পালিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালি যখন ভারতে এসেছিলেন আমরা কি তাদের পুশব্যাক করেছিলাম?’
‘উনি সে প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি!’, স্পষ্ট জানান মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী।
আসলে বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডে যেহেতু দু’দশকের বেশি সময় ধরে গেরিলা যোদ্ধার জীবন কাটিয়েছেন, সে দেশের প্রতি জোরামথাঙ্গার একটা আলাদা দুর্বলতা আছেই।
এমন কী বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন, তখন থেকেই জোরামথাঙ্গা-সহ মিজো নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।
২০০৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া যখন ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন, তখন জিয়া পরিবারের সঙ্গে সেই পুরনো পরিচয়ের সুবাদে তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে ভারত সরকার জোরামথাঙ্গাকে দিল্লিতেও ডেকে পাঠিয়েছিল।
তখন মুখ্যমন্ত্রীর পদে না-থাকলেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দিল্লিতে তার সেবার মুখোমুখি বৈঠক হয়েছিল, পুরনো দিনের অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল।
ফলে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার বা বাংলাদেশে বহু ক্ষেত্রে ট্র্যাক-টু কূটনীতির কাজ হাসিল করতে জোরামথাঙ্গা বহুদিন ধরেই ভারত সরকারের হয়ে কাজ করছেন– কখনো প্রকাশ্যে, কখনো অন্তরালে।
এখন কেন অভিমানী?
সাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা থেকে আদর্শ ‘দেশপ্রেমী’তে পরিণত হওয়া জোরামথাঙ্গা যে ইদানীং কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর রুষ্ট– তা আর গোপন নেই। আর এর প্রধান কারণ হলো মণিপুরের সঙ্কট।
মণিপুরে রক্তাক্ত জাতি সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার থেকে অন্তত হাজার পনেরো কুকি ওই রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে লাগোয়া মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন।
এরই মধ্যে দু’জন কুকি নারীকে নগ্ন করে ঘোরানোর ভিডিও সামনে আসার পর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে মিজোরাম। মিজো-কুকি-চিন সৌভ্রাতৃত্বের ডাকে আইজলে বিশাল মিছিলে পা মিলিয়ে হেঁটেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
গত এক সপ্তাহের ভেতর তিনি ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জোরামথাঙ্গা এমন কিছু সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন, যাতে তার তীব্র ক্ষোভ পরিষ্কার ফুটে বেরিয়েছে।
দ্য প্রিন্ট-কে তিনি যেমন বলেছেন, ‘মণিপুর সিচুয়েশন কেন্দ্র যেভাবে ডিল করছে, তাতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।’
ইন্ডিয়া টুডে-কে তিনি জানিয়েছেন, ‘ভারত যদি ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ঠাঁই দিতে পারে, তাহলে আজো মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে পারবে। এতে কেন্দ্র যদি অন্য রকম কিছু ভাবে -তাতে তার কিচ্ছু করার নেই!’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি গোটা ভারত জুড়ে যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের ডাক দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছেন তিনি।
হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, ‘মোদি সরকার যদি মিজোরামে ইউসিসি চালু করার চেষ্টা করে তাহলে আমরা এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দ্বিধা করব না।’
মিজোরামে বিধানসভা ভোট হতে আর মাস চারেকও বাকি নেই। তার আগে ‘মিজো সাবন্যাশনালিজম’-কে উসকে দিতে এটাকে অনেকে জোরামথাঙ্গার ‘পলিটিক্যাল পশ্চারিং’ বা রাজনৈতিক অবস্থান নেয়ার চেষ্টা বলেও মনে করছেন।
আসল কারণটা যাই হোক, আজকের তারিখেও জোরামথাঙ্গার টুইটার ডিপি-তে যে ছবি রয়েছে তাতে তাকে হাসিমুখে নরেন্দ্র মোদির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু মিজোরামের বেপরোয়া আর ব্যতিক্রমী মুখ্যমন্ত্রী আর কতদিন সেই ছবিটা ডিপি-তে রাখবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়!
সূত্র : বিবিসি
বিডিসংবাদ/এএইচএস