জি-সেভেন শীর্ষ বৈঠকের টেবিলে কেন ৮টি অতিরিক্ত চেয়ার

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

জি-সেভেন বৈঠকটি যদি কোনো ডিনার পার্টি হতো তাহলে নিমন্ত্রণকর্তাকে অতিরিক্ত চেয়ার আর প্লেট-গ্লাস-চামচের জন্য দৌড়াতে হতো। তবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর এই জোটের চলতি বছরের এই শীর্ষ বৈঠকের আয়োজক, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, বাড়তি অতিথির জন্য প্রস্তুত।

কারণ, শুক্রবার থেকে হিরোশিমাতে শুরু হওয়া এই বৈঠকে তিনি নিজের পছন্দে জোটের বাইরের আটটি দেশের নেতাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছেন।

পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে যে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট এবং চীনের সাথে সম্পর্কের কৌশল নির্ধারণের মতো জটিল ইস্যুগুলোতে বাকি বিশ্বকে পাশে রাখার প্রয়োজনীয়তা কতটা বোধ করছে জি-সেভেন জোট।

বিশ্ব ব্যবস্থা যে বদলে যাচ্ছে তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ, যে দুই দেশকে নিয়ে হিরোশিমার এই বৈঠক সরগরম থাকবে, সেই চীন ও রাশিয়া অতিথি তালিকায় অনুপস্থিত।

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী গণতান্ত্রিক সাতটি দেশ এই জোটের সদস্য – যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, কানাডা ও জাপান। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব সময় জি-সেভেন জোটের শীর্ষ বৈঠকে প্রতিনিধি পাঠায়।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে আয়োজক দেশ বাইরে থেকে তাদের পছন্দমত ক’জন বিশ্বনেতাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে।

কারণ, জি-সেভেন জোটের অর্থনৈতিক শক্তি ক্রমাগত কমছে। ১৯৯০ সালে যেখানে বিশ্বের জিডিপিতে এই জোটের দেশগুলোর অবদান ছিল অর্ধেকেরও বেশি, এখন তা ৩০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। ফলে তাদের এখন জোটের বাইরের প্রভাবশালী বন্ধু প্রয়োজন।

তাই কিশিদা-যিনি পশ্চিমা একটি কোয়ালিশনের চাইতে আন্তর্জাতিক একটি কোয়ালিশনের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী-বৈঠকের টেবিলে বসার জন্য অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কোমোরোস (আফ্রিকার ইউনিয়নের প্রতিনিধি) এবং কুক আইল্যান্ডসকে (প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতিনিধি) আমন্ত্রণ করে এনেছেন।

গত ১৮ মাসে কিশিদা ১৬ বার বিদেশ সফর করেছেন। ভারত, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে গেছেন। তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন চীন ও রাশিয়ার টাকা-পয়সা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির বিকল্প তাদের সামনে রয়েছে।

হিরোশিমায় তার আমন্ত্রিত অতিথিদের দিকে তাকালে বোঝা যায় কিশিদা এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রভাবশালী দেশগুলোকে-যাদেরকে এখন ‘গ্লোবাল সাউথ’ নামে অবিহিত করা হয় এবং যারা চীন ও রাশিয়ার সাথে জটিল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রেখে চলেছে-আস্থায় রাখার চেষ্টা করছেন, তাদের সাথে আরো ঘনিষ্ট হতে চাইছেন।

ঐক্যে ফাটল
কিশিদার অন্যতম লক্ষ্য এটি তুলে ধরা যে ইউক্রেনে রুশ হামলার বিরুদ্ধে পুরো বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু এই লক্ষ্য হাসিলে তাকে খুবই বেগ পেতে হবে। সাফল্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

জি-সেভেন জোট চাইছে রুশ জ্বালানি এবং রফতানির ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা চাপানো যাতে রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আরো কমে।

কিন্তু গ্লোবাল সাউথ থেকে যে অতিথিদের কিশিদা ডেকে এনেছেন তাদের অনেকেই এতে রাজী হবেন না।

ভারত এখন পর্যন্ত পশ্চিমাদের চাপাচাপিকে অগ্রাহ্য করে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। তারা এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে হামলার জন্য সরাসরি রাশিয়ার নিন্দা করেনি। ভারতের বক্তব্য স্পষ্ট-রাশিয়ার সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্কের ঐতিহ্য ছাড়াও বাড়তি দাম নিয়ে তেল আমদানি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

শুধু ভারত নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বে অনেক দেশেরই অবস্থান একই রকম, কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানি এবং খাদ্যের সংকটের প্রধান শিকার হয়েছে তারা।

এসব দেশে ভয় পাচ্ছে, রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা বসালে মস্কো কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনকে খাদ্যশস্য রফতানি করতে দেয়ার চুক্তি থেকে সরে আসবে এবং তার জেরে খাদ্যের দাম আরো একদফা বাড়বে।

তবে অনেক দেশের কাছে এটা শুধু অর্থনৈতিক চাপের প্রশ্ন নয়।

‘ঐতিহাসিকভাবে ভিয়েতনামের সাথে রাশিয়ার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এখনো ভিয়েতনামের অস্ত্রের ৬০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। সারের ১১ শতাংশ আসে ওই দেশ থেকে,’ বলেন সিঙ্গাপুরে ইন্সটিটিউট অব সাউথ ইস্ট এশিয়ার ভিজিটিং শিক্ষক এনগুয়েন খাক গিয়াং।

‘ইন্দোনেশিয়া অতটা নির্ভরশীল না হলেও তারা রাশিয়ার কাছ থেকে অনেক অস্ত্র কেনে। মস্কোর সাথে তাদের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ।’

ফলে, এনগুয়েন খাক গিয়াং মনে করেন রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা এই দুই দেশ সমর্থন করবে না। ‘কারণ, তেমন সমর্থন এই দুই দেশের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে, কিন্তু বদলে তাদের তেমন কোনো লাভ নেই।’

তবে কিশিদা হয়তো আশা করছেন হিরোশিমার করুণ অভিজ্ঞতার ইতিহাস তুলে ধরে তিনি হয়ত বাকি বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হবেন যে রাশিয়া পারমানবিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করেছে। তাদের ঠেকাতে হবেই।

রাশিয়ার ওপর আরো চাপ তৈরির জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির কাছ থেকেও চাপ আসবে যিনি ভিডিওতে জি-সেভেন শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেবেন।

তবে তাতে বাড়তি নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে বিরোধের সুরাহা তাতে হবে না।

এমনিতেই বাইরের বিশ্বের অনেক দেশের মধ্যেই হতাশা ও রাগ রয়েছে যে পশ্চিমারা তাদের কথার বা মতামতের তোয়াক্কা করে না।

তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন এসব দেশের কথা শোনা, তাদেরকে সহযোগী হিসাবে মর্যাদা দেয়ার একটা সূচনা অন্তত হিরোশিমাতে হতে পারে।

‘এসব দেশ (ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম) ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট বা দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান নিয়ে বিরোধের জেরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাদের উদ্বেগ মুখোমুখি বসে জি-সেভেন নেতাদের বলার একটি সুযোগ পাচ্ছে,’ বলেন এনগুয়েন খাক গিয়াং।

চীনের সাথে টক্কর
তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা গত এক বছর ধরে বিশ্বের অন্যতম নিরাপত্তা সঙ্কট। জাপান জি-সেভেন জোটে একমাত্র এশীয় সদস্য। ফলে, তাইওয়ান ঘিরে চীন যে সামরিক তৎপরতা চালাচ্ছে তার একটি বিহিত নির্ধারণের চেষ্টা কিশিদা নিশ্চিতভাবে করতে চাইবেন।

পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি জাপানের বার্তা খুব সোজাসাপ্টা। ইউক্রেনে তোমাদের যুদ্ধকে আমরা আমাদের যুদ্ধ বলে মনে করছি কিন্তু জাপান প্রতিদান আশা করে।

কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে তাদেরকে ঘায়েল করার কোনো চেষ্টা রাশিয়ার চেয়ে অনেক কঠিন।

সম্প্রতি বেইজিং সফরে গিয়ে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন ইউরোপের উচিৎ হবে না ‘যে সংকট আমাদের নয়, সেখানে জড়িয়ে পড়া।’ তার এই বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোতে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তবে একই সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেকে দেশের মধ্যে ভয় ঢুকেছে তাদের বিপদে পশ্চিমা মিত্রদের হয়তো পাশে পাওয়া যাবে না।

সেদিক দিয়ে চীনের অবস্থান অনেক স্পষ্ট। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো প্রতিটি নির্বাচনের পর তাদের অবস্থানে বদল হয় না।

তবে এটা ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্র গত এক বছরে ইউক্রেনের প্রতি সাহায্য অব্যাহত রেখেছে, এক ইঞ্চিও সরেনি। তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও তাই। প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে চীনের সাথে বিরোধে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স এবং অস্ট্রেলিয়াকে শক্তভাবে ভরসা দিচ্ছে তারা।

কিন্তু জি-সেভেন জোট শুধু চীনের সামরিক উচ্চাভিলাষকে টার্গেট করছে না। তারা চীনের ‘অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের’ কৌশল নিয়েও উদ্বিগ্ন।

ইদানীং চীন তাদের স্বার্থ-বিরোধী যেকোনো কিছুর পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে। যেমন ২০১৯ সালে তারা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ওপরও একই ধরনের চাপ তৈরি করেছিল বেইজিং।

তবে চীনের ব্যাপারে জি-সেভেন ঠিক কি পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে তা পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে জোটের ইউরোপীয় সদস্যরা কতটা আগ্রহী হবে তাও নিশ্চিত নয়। কারণ, চীনে ইউরোপের বাণিজ্যিক স্বার্থ এখন বিপুল।

কিন্তু চীনের ব্যাপারে কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ আসবে জি-সেভেন জোটের বাইরের দেশগুলো থেকে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় চীনের অর্থনীতির ওপর তাদের নির্ভরতা এখন অনেক বেশি। লাতিন আমেরিকার সাথে চীনের বাণিজ্য দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ওই অঞ্চলের জিডিপির ৮.৫ শতাংশ আসছে চীনের সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে। ব্রাজিল বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের মধ্যে একটি যারা চীন থেকে আমদানির চেয়ে ওই দেশে রফতানি করে বেশি।

চীনের ওপর আফ্রিকার নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। ঘানা এবং জাম্বিয়াসহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ চীনা ঋণে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ঋণ ঠিকমত শোধ দিতে পারছে না তারা।

চীনের সাথে পশ্চিমাদের প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ের সর্বশেষ ক্ষেত্র হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। সে কারণেই সম্ভবত ক্ষুদ্র দেশ কুক আইল্যান্ডকে হিরোশিমায় আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এসব দ্বীপরাষ্ট্রগুলো এখন চীন ও আমেরিকার কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গত বছর বেইজিং সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করার পরই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে যে চীন সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। সাথে সাথে ওই অঞ্চলের ১৪টি দেশকে ৮১ কোটি ডলার অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

তবে তারপরও চীনের বিরুদ্ধে রেষারেষিতে এই দেশগুলোকে দলে রাখা কতটা সহজ হবে তা অনিশ্চিত। সহজ যে হবে না তার কিছুটা ইঙ্গিত এখনই দেখা যাচ্ছে।

হিরোশিমায় শীর্ষ বৈঠকের পর জো বাইডেনের পাপুয়া নিউ গিনি সফরে যাওয়ার কথা। সেটাই হতো প্রশান্তমহাসাগরীয় ওই দেশে আমেরিকান কোনো প্রেসিডেন্টের প্রথম সফর। কিন্তু সরকারি ঋণের ওপর সিলিং নিয়ে নিজের দেশে যে গভীর সঙ্কট তৈরি হয়েছে তাতে করে এই সফর হয়ত হবে না।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গোয়েন্দা প্রধান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইন্সটিটিউটের গবেষক রিচার্ড মুয়াডের মতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফর না হলে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে।

‘ওই অঞ্চলের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে হলে আপনাকে সেখানে যেতে হবে। এটি ওই অঞ্চলের সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু গেলেই অর্ধেক উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়। চীনারা সব সময় সেখানে যাচ্ছে। সে তুলনায় পশ্চিমাদের তেমন চোখে পড়ে না।’

সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here