নির্বাচনকে সামনে রেখে যেভাবে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

বাংলাদেশে চলতি বছরের শেষ কিংবা আগামী বছরের প্রথমে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য কৌশল নির্ধারণের কাজ শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, দলকে প্রস্তুত করার অংশ হিসেবে একাধিক তৎপরতা এখন চলছে যার মূল উদ্দেশ্য হলো মাঠ পর্যায়ে কর্মী ও সমর্থকদের চাঙ্গা করে নির্বাচনের আবহ তৈরি করা। এটি করতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে নেতাদের মধ্যে কোন্দল নিরসনের ওপর।

একইসাথে নানা ঘটনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সে কারণে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের কৌশলও নিয়েছে দলটি।

পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলোর সাথে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে ‘চাপ মোকাবেলা’র চেষ্টাও চলছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে নানা ধরনের বিবৃতি দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে নানা বার্তা আসছে। তাদের এসব তৎপরতা ক্ষমতাসীনদের উপর চাপ তৈরি করছে বলে অনেকে মনে করেন।

যদিও সরকার কখনো এ ধরনের চাপের কথা স্বীকার করেনি।

ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা
বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে বেশ সমালোচিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে সমালোচনা আছে।

এছাড়া সাংবাদিক নির্যাতন ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধাসহ মানবাধিকার ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে বেশ কড়া প্রতিক্রিয়াও এসেছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে।

আমেরিকার তরফ থেকে র‍্যাব ও এর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় ক্ষমতাসীনদের উপর চাপ বেশ দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও চাপের বিষয়টি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকার করে না।

সরকার কিভাবে এগুলো মোকাবেলা করবে তা নিয়ে দলের মধ্যেই নানা ধরনের আলোচনা ছিলো। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ‘ভাবমূর্তি উজ্জ্বল’ করার দিকেই তাই এখন নজর দিচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগ।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যেসব সমালোচনা তৈরি হয়েছে সেটির বিপরীতে অবকাঠামো উন্নয়ণের বিষয়টিকে সামনে আনতে চায় আওয়ামী লীগ।

সরকার বিশ্বের কাছে দেখাতে চায় যে সমালোচনা যাই থাকুক না কেন, গত ১৫ বছরে তারা দেশের ‘উন্নয়ণ’ করেছে।

মার্চ মাসে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ বিজনেস সামিট। বিজনেস সামিটকে সামনে রেখে প্রচারের জন্য সিএনএন কমার্শিয়ালের সাথেও চুক্তি করেছিলো এফবিসিসিআই। এর আওতায় চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ–সম্ভাবনা নিয়ে প্রচারণা চালাবে সিএনএন।

অবশ্য আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলছেন যে দল বা সরকারের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত বা নষ্ট হয়েছে এমনটি তারা মনে করেন না।

“অনেক সময় বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশীদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। তারা রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী। তাই ভাবমূর্তি পুনুরুদ্ধারের কোনো বিষয় নেই। তবে সরকারের যে অর্জন সেটি আমরা আরো বেশি করে তুলে ধরতে চাইছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মাহমুদ।

কূটনীতিকদের সাথে বোঝাপড়া
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী সাথে ভারত এবং চীনের সম্পর্ক যতটা ভালো, ঠিক ততটা ভালো নয় পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে, বিশেষ করে আমেরিকার সাথে।

সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ঢাকায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা নিয়ে খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন।

আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেকেই মনে করছেন, আমেরিকার সাথে তাদের একটি বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার ছাড়াও ঢাকায় বিদেশী কূটনীতিকদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন দলের সিনিয়র নেতারা।

সম্প্রতি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় গিয়েছিলেন।

পরে দূতাবাস টুইট করে জানিয়েছে যে এসময় রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং বাণিজ্য থেকে শুরু করে জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

এছাড়াও বিদেশী কুটনীতিকদের সাথে নিয়মিত বিভিন্ন ভাবে কথা বলছেন দলের সিনিয়র নেতারাও।

বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও বিদেশীদের সাথে আলোচনা করতে দেখা যাচ্ছে দলটির নেতাদের।

যদিও দলের নেতারা গণমাধ্যমে বলছেন সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কারো মধ্যে যেন কোনো সংশয় না থাকে সে চেষ্টাই করছেন তারা।

“কুটনীতিক ও বিদেশী প্রতিনিধিদের সাথে সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। তাদের কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা বলেছেন। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি যে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। তারাও বিষয়টি অনুধাবন করেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ।

মাহমুদ জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাম্প্রতিক আলোচনায় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে ছিলেন।

সাংগঠনিক তৎপরতা
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের মূল কাজটি হলো সঠিক প্রার্থী বাছাই করা এবং সে কাজটিই তারা এখন করছেন।

“দলের প্রার্থীদের নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। দলের কারো কারো বিরুদ্ধে নানা নেতিবাচক খবর এসেছে। আপনারা এগুলো জানেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

ফারুক খান বলছেন গত ডিসেম্বরে দলের জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়েই আগামী নির্বাচনের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ২০০৮ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ।

“সম্মেলনে সবাইকে বার্তা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনকে সামনে রেখে করণীয় সম্পর্কেও তৃণমূলের নেতাদের তখন ব্রিফিং করা হয়েছে,” বলছিলেন তিনি।

পরে জানুয়ারিতে গণভবনে দলের এক যৌথ সভায় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে জয়ের জন্য তিনটি করণীয় ঠিক করে দিয়েছিলেন দলের নেতাদের।

এগুলো হলো- দলের প্রতিটি স্তরে কোন্দল নিরসন, নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং ভোটারদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সরকারের ‘উন্নয়নের চিত্র’ তুলে ধরা বা প্রচার করা।

এর অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নিজেও ঢাকার বাইরে একাধিক সমাবেশ করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন।

এসব সমাবেশ গুলোতে নির্বাচনী শ্লোগান ও দলের নির্বাচন প্রতীককে ব্যাপকভাবে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। সামনে ঈদের পর প্রধানমন্ত্রী আরো সমাবেশ করবেন বলে আশা করছে দলটির নেতারা।

এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে শেখ হাসিনা নির্বাচনী এলাকায় বেশি সময় দেয়া ছাড়াও সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর জন্য এমপিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এরই আলোকে জেলা ও উপজেলায় যেখানে সম্মেলন হয়ে গেছে সেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

অন্তত ৩০টি জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এসব জেলার বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে তা নিয়েও দলের মধ্যে আলোচনা আছে।

ঢাকায় বিভিন্ন জেলা কমিটির নেতাদের ডেকে এনে প্রায়শই আলোচনা করছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সমাবেশ ও দলীয় সভাগুলোতে যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতাদের।

এছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের জোটের পরিধি বাড়ানো যায় কিনা এবং জোটের বাইরে মিত্র তৈরির বিষয়ে কাজ করছেন দলের একদল নেতা।

সম্ভাব্য প্রার্থী জরিপ
পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন মাধ্যমে সারাদেশের ৩০০ নির্বাচনী আসনের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে ধারণা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

সম্প্রতি এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “আমি খোঁজ নিচ্ছি। জরিপও করেছি। যাদের কারণে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে এবং যাদের সাথে মানুষের সম্পর্ক নেই তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে না”।

দলের সূত্র গুলো বলছে এ জরিপটি মূলত এমপিদের বিষয়ে করা হয়েছে। অর্থাৎ এমপিদের অবস্থান, ভাবমূর্তি ও জনমনে তাদের ইমেজ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এ জরিপ থেকে।

“কারও কারো নামে নেতিবাচক খবর এসেছে। এগুলো আপনারাও জানেন। সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে এবং বিস্তারিত তথ্য নেয়া হচ্ছে। আমরা দেখবো দল ও মানুষের সাথে সম্পৃক্ত কারা। আর কোভিডের সময় কে কেমন ভূমিকা রেখেছেন সেটি বিশেষভাবে দেখা হবে,” বলছিলেন খান।

এছাড়াও দলের একজন সিনিয়র নেতার নেতৃত্বে দলের ইশতেহার ও ঘোষণাপত্রের বিষয়ে প্রাথমিক কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।

পাশাপাশি ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সবগুলো সংসদ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণের কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে দেখা হয়েছে দলের অবস্থা কোন এলাকায় কেমন ছিলো এবং এখন কী অবস্থায় আছে।

দলের একজন নেতা বলেছেন প্রতিটি আসন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিতে একাধিক জরিপ চলমানও আছে বলে তারা মনে করছেন।

ফারুক খান বলছেন, “প্রধানমন্ত্রী জরিপ করেছেন এবং আমরাও করছি। কোথায় কি অবস্থা সেগুলো দেখা হচ্ছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে জনপ্রিয় প্রার্থীদের খুঁজে পেতে”। সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস