আমাকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়েছে : সামিয়া রহমান

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

গবেষণা প্রবন্ধে জালিয়াতির অভিযোগে পদাবনতির শাস্তি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাননি বলে দাবি করে বলেছেন, তাকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়েছে।

সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সামিয়া রহমান আরো দাবি করেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ও ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।
সামিয়া রহমান বলেন, যে গবেষণার লেখার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেটা তিনি লেখেননি, জমাও দেননি। এ সংক্রান্ত প্রমাণও তার কাছে আছে বলে দাবি করেন।

এ ‘ষড়যন্ত্রের’ পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ কেউ এবং কিছু শিক্ষক জড়িত রয়েছেন বলে মনে করেন তিনি। তবে তাদের নাম তিনি না বলে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে তা বের করতে সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ জানান

সামিয়া রহমান বলেন, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আমার ভগ্নিপতি মারা যাচ্ছেন, এমন খবর পেয়ে স্বল্প সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দেন। বিমানবন্দরে পৌঁছানো পর ডিন অফিস থেকে প্রথম ফোন দিয়ে বলা হয়, আপনি ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান যৌথভাবে যে লেখাটি জমা দিয়েছি, সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটি শোনার পর খুব অবাক হই। কারণ, আমি সাম্প্রতিক সময়ে ডিন অফিসে কোনো লেখা জমা দিইনি।

তিনি বলেন, ডিন অফিসের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সাবেক ছাত্র মারজানকে ফোন দিয়ে জানতে চাই, কোন লেখার কথা বলছে ডিন অফিস। মারজান তখন বলে, ম্যাডাম আপনি যে আইডিয়া দিয়েছিলেন সেটি। তখনই জানতে পারলাম মারজান আমার আইডিয়ার লেখাটি সংশোধন, বিয়োজন করে নিজের ভাষায় লিখে রেফারেন্সসহ ডিন অফিসে জমা দিয়েছে এবং সেটি ডিন অফিস গ্রহণও করেছে। মারজান আর আমি ওই সময় দায়িত্ব ভাগাভাগি করে গবেষণার কাজগুলো করতাম।

সাংবাদিকতার এই শিক্ষক বলেন, আমি মারজানকে বারবার প্রশ্ন করেছিলাম, লেখার বিশ্লেষণ ঠিকমতো করেছ কি না, রেফারেন্স ঠিকমতো দিয়েছ কি না। সে দায়িত্ব নিয়ে বলেছে, ম্যাডাম আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন, সব ঠিকভাবে হয়েছে। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমাকে না দেখিয়ে সে ডিন অফিসে লেখাটি কেন জমা দিয়েছে। আর রিভিউয়ারের কপি আমাকে পাঠাল না কেন? সে শুধু আমাকে ‘স্যরি’ বলেছে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরও মারজানকে ডিন অফিসে যোগাযোগ করতে বলি এবং আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত লেখাটি না ছাপানোর জন্য বলি। তখন মারজান বলে, সব লেখা ও রিভিউয়ারের কপি তার কাছে আছে। সে ডিন অফিসে পাঠিয়ে দেবে।

সামিয়া রহমান আরো জানান, লেখাটি ছাপা হয়েছে এটা প্রথম জানতে পারি ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ডিন ফরিদউদ্দীন স্যার আমাকে ফোনে জানান, তোমার যে লেখাটি ছাপা হয়েছে, এ লেখায় তুমি প্লেজারিজম (চৌর্যবৃত্তি) করেছ, এমন অভিযোগ করেছেন তোমার বিভাগের দুজন শিক্ষক। তারা তোমার শাস্তি চান। তখনই আমি ফরিদ স্যারের কাছে জানতে চাই, কোন লেখাটি। তখন তিনি তার অফিসে আমাকে ডেকে লেখা ও অভিযোগের বিষয়টি জানান। কিন্তু মারজান অসম্পূর্ণ একটি লেখা আমাকে না জানিয়ে ডিন অফিসে জমা দেয়। সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি এবং আমাকেও বিষয়টি জানায়নি। আমি স্বীকার করছি, আমার দায়িত্ব ছিল কী লেখা হচ্ছে বা কী যাচ্ছে, ওই বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া। কিন্তু মারজান যে ডিন অফিসে আমার অনুমোদন ছাড়া লেখাটি পাঠিয়ে দিয়েছে, বিষয়টি আমি জানতাম না। লেখা ছাপা হওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেহেতু আমি জড়িত ছিলাম না, তাই দেরি না করে সেটা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাই ডিন স্যারকে। আমি ওই সময় লেখা প্রত্যাহারের আবেদন করি, সেই স্বাক্ষরযুক্ত চিঠিও আছে আমার কাছে।

তিনি জানান, লেখাটি প্রত্যাহারের বিষয়ে তৎকালীন ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারকে অবহিত করলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিন্ডিকেটে বিষয়টি তুলতে বলেন। কিন্তু ড. ফরিদউদ্দীন বিষয়টি জিইয়ে রাখেন সময় ও সুযোগের জন্য। সাত মাস ধামাচাপা দিয়ে রাখার পর ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আরেফিন স্যার উপাচার্যের চেয়ার থেকে সরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ওই ভুয়া চিঠিটি তৈরি করা হয় শিকাগো জার্নালের নামে, অ্যালেক্স মার্টিনের পরিচয় দিয়ে। যেখানে অ্যালেক্স মার্টিন বলে কারও অস্তিত্ব নেই এবং চিঠিটিও শিকাগো জার্নাল থেকে পাঠানো হয়নি।

সামিয়া রহমান বলেন, আমার লেখায় প্লেজারিজমের মূল দলিল হিসেবে তদন্ত কমিটি শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যালেক্স মার্টিন পরিচয় দিয়ে যে চিঠিটি আমলে নেয়া হয়েছে সেটিও পুরোপুরি মিথ্যা। এমন একটি দলিল আমার হাতে রয়েছে। আমি শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করার পর তারা জানিয়েছে, অ্যালেক্স মার্টিন বলে কেউ নেই এবং তারা এ ধরনের চিঠি পাঠায়নি। শিকাগো জার্নালের এডিটর নিজেই এটি স্বীকার করেছেন। তাই পুরো ঘটনাটি মিথ্যা। আমাকে ফাঁসানোর জন্য ভুয়া চিঠিটি তৈরি করা হয়।

লেখাটি ছাপানোর প্রক্রিয়ায় ভুল ছিল দাবি করে তিনি বলেন, প্রক্রিয়াটি ভুল ছিল এ বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল ও প্রাক্তন ভিসি বলেছেন। আমি দালিলিকভাবে প্রমাণ করতে পারব ছাপা হওয়ার প্রতিটি স্তরে কীভাবে ভুল হয়েছে। একজন একটি লেখা জমা দেওয়ার পর তা রিভিউয়ারের কাছে যায়। তিনি কারেকশন (সংশোধনী) দিয়ে লেখককে পাঠান। সেটি সংশোধনের পর সম্পাদনা পরিষদ দেখে ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পর সেই লেখা ছাপা হয়। কিন্তু এ লেখার অসঙ্গতিগুলো রিভিউয়ার, সম্পাদনা পরিষদ দেখেনি। লেখা ছাপার সঙ্গে রিভিউয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ডিন অফিস ও সম্পাদনা পরিষদ জড়িত। কিন্তু এখানে এককভাবে জোর করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে।

গত ২৮ জানুয়ারি একাডেমিক গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের পদাবনতি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি পিএইচডি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুককেও একই শাস্তি দেওয়া হয়।

সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সামিয়া ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মারজানের যৌথভাবে লেখা ‘আ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: আ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ শীর্ষক আট পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ পাঁচ পৃষ্ঠা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে হুবহু নকল করেছেন।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানায় ওই গ্রন্থের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস নিবন্ধটিতে ফুকো ছাড়াও ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন বুদ্ধিজীবী অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’ গ্রন্থের পাতার পর পাতা হুবহু কপি করা হয়েছে।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদকে প্রধান করে একটি কমিটি করে সিন্ডিকেট। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটি কোনো শাস্তি দেওয়ার কথা বলেনি।

এরপর গত বছরের অক্টোবরে সিন্ডিকেট সভায় আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল ইনক্রিমেন্ট কাটার মতো ‘লঘু শাস্তির’ সুপারিশ করলেও সিন্ডিকেট তা নাকচ করে তাদের পদাবনতি দিয়েছে।

বিডিসংবাদ/এএইচএস