আলোচিত সাত খুন মামলার রায় সোমবার তাকিয়ে নারায়ণগঞ্জসহ দেশবাসী

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ

প্রায় দীর্ঘ আড়াই বছর যাবত বিচারকার্য চলার পর অবশেষে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে। আগামী সোমবার (১৬ জানুয়ারী) নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৈয়দ এনায়েত হোসেন এই রায় ঘোষণা করবেন। যা দেখতে নারায়ণগঞ্জবাসীর পাশাপাশি অধীর আগ্রহে এখন তাকিয়ে আছে গোটা দেশবাসী।

কেননা, বিগত ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহরন হওয়ার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর ত্রিমোহনায় বন্দর শান্তিরচর এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় প্রত্যেকের বিভৎস্য লাশ উদ্ধারের পর উত্তপ্ত হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ।

উক্ত ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন প্রবীন আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার নিহত হওয়ায় রাজপথ থেকে আদালত অঙ্গন পর্যন্ত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
আর এই অপহরন আর সাতজনকে খুন গুমের নেপথ্যে তৎকালীন সিটি কর্পোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিদ্ধিরগঞ্জের ডন আওয়ামীলীগ নেতা নূর হোসেন, র‌্যাব-১১’র সিইও লেফটেন্যান্ট কর্ণেল চাকুরিচ্যুত তারেক মোহাম্মদ সাঈদসহ র‌্যাবের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার তথ্য ফাঁস হওয়ার পর বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি চলে আসে নারায়ণগঞ্জের দিকে। নিহতদের পরবিারকে সান্তনা দিতে নারায়ণগঞ্জ আসেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ আওয়ামীলীগ ও জাতীয়পার্টি শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দরাও।

অপহরনের নির্দেশ দাতা নূর হোসেনের ভারতে পলায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী এক সাংসদের জড়িত থাকার মোবাইল কথপোকথন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর আরো বেশী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একজন কাউন্সিলরের নির্দেশে কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই তারেক সাঈদ তার নিন্মপদস্থ র‌্যাব কর্মকর্তাদের দিয়ে এমন জঘন্য ঘটনোয় র‌্যাবকে নিয়ে দেশজুড়ে জনমনে এক ভ্রান্ত ধারনার সৃষ্টি হয়। যা অবশ্য পরবর্তীতে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় র‌্যাব।

সাত খুনের ঘটনার সাথে জড়িত আসামীদের সাথে সখ্যতা থাকার অভিযোগে তৎকালীন র‌্যাবের এডিজি কর্ণেল জিয়াউল হক, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানসহ হেভীওয়েট অনেককেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় গঠিত তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হয়।

এরপর সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনের ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেফতার হওয়া, এরপর বাংলাদেশে তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারকার্য সম্পন্ন করাকালীন সময় জুড়ে দেশজুড়ে বেশ আলোচিত হয়ে উঠে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি।
অত:পর ঘোষণা হচ্ছে আলোচিত এই সাত খুন মামলার রায়। মামলায় ৩৫ জন আসামীর মধ্যে ২৩ জন গ্রেফতার থাকলেও বাকী ১২ জনকে পলাতক দেখিয়েই সাক্ষ্য ও জেরার পর গত ৩০ নভেম্বর যুক্তিতর্ক শেষ হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন, প্রধান আসামী নূর হোসেন, চাকরিচ্যুত র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, উপ-অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এমএম রানা, ল্যান্সনায়েক বিল্লাল হোসেন, সাবেক এসআই পুর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার মো. ইমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. সিহাব উদ্দিন, রেডিও অপারেটর গেইন (আরওজি) মো. আরিফ হোসেন, এএসআই বজলুর রহমান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার ও গাড়িচালক নাসিরউদ্দিন, সিপাহী নুরুজ্জামান, বাবুল হাছান, সিপাহী সাবেক সেনা সদস্য আসাদুজ্জামান এবং নূর হোসেনের প্রধান বডিগার্ড মর্তুজা জামান চার্চিল, প্রধান ক্যাশিয়ার আলী মোহাম্মদ, ক্যাশিয়ার সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক আবুল বাশার, মাদক স্পট পরিচালনাকারী রহম আলী ও মিজানুর রহমান।

আর পলাতকরা হলেন, নূর হোসেনের সহযোগী ভারতে গ্রেফতার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন, র‌্যাবের কর্পোরাল লতিফুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলী, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান।

সাত খুনের ঘটনায় দু’টি মামলা দায়ের হলেও ১২৭ জনকে অভিন্ন সাক্ষী করা হয়। যার মধ্যে ১০৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী এড. ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার বিত্তশালী আসামীদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিহত দরিদ্র পরিবারের মধ্যে বন্টনের আবেদন জানিয়েছি। সেই সাথে সকল আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত করতে পারায় আদালতের কাছে সকলের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আবেদন করেছি।

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, সাত খুনের মামলার সুষ্ঠু বিচার হবে- এ প্রত্যাশা শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীর না, সমগ্র দেশবাসীর। আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা রয়েছে। সেই আস্থা থেকেই আমার প্রত্যাশা, আদালত আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করবেন।

আর নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও একটি মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি জানান, আমরা আদালতে আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করেছি। আমরা চাই, আদালত আসামীদের মৃত্যুদন্ড দিবেন।
আরেক মামলার বাদী নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা ডা. বিজয় কুমার পাল জানান, বিচার শেষে আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে এমনটাই প্রত্যাশা করছি।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ তার পাঁচ সহযোগীকে অপহরণ করা হয়। একই সময় একই স্থান থেকে অপর একটি গাড়ীতে থাকা নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়ির চালককেও অপহরণ করা হয়। ঘটনার তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকার তীর থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।