এখনো ভোগান্তিতে নগর পরিবহন

পাতানো ফাঁদ ‘সিটিং সার্ভিস’ ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করা হলেও রাজধানীতে নগর পরিবহনের যাত্রীদের দুর্ভোগের চিত্র একদমই পাল্টায়নি। নগরজুড়ে বিভিন্ন নামে চলা আগের সিটিং সার্ভিসগুলোতে ভাড়া একই থাকলেও গাদাগাদি করে লোক উঠানোই ভোগান্তিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রতিটি স্টপে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করায় চাকরিজীবীদের অফিসে যেতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়েও যাত্রী-হেলপার তর্কবিতর্ক, ঝগড়াঝাটি, হাতাহাতি লেগেই আছে। এ দিকে সিটিং সার্ভিস বন্ধের দ্বিতীয় দিনেও বাস চলাচল ছিল সীমিত। এতে পরিবহন সঙ্কটে পড়েন রাজধানীর কর্মব্যস্ত মানুষেরা। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কোনো বাস না পাওয়ায় এবং অনেকেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন নারীরা। সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় অনেক বাসে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট সিট উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। গাড়িতে ভিড়ও ছিল বেশি। ফলে ওই ভিড় ঠেলে দাঁড়িয়েই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেককে। আজ সোমবার রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, জাতীয় প্রেস ক্লাব, কাকরাইল মোড়সহ বেশ কয়েকটি বাসস্টপিজ ঘুরে এরকম চিত্রই দেখা গেছে।

মতিঝিল থেকে মিরপুরের দিকে নিউভিশন, বিকল্প পরিবহন, মিরপুর-১২ সহ বেশ কয়েকটি বাস সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে চলাচল করত। সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে আজও ওই বাসগুলো আগের ভাড়া ২৫ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করেছে। ফার্মগেট থেকে মিরপুর পর্যন্ত আদায় করেছে ১৫ টাকা। সকালে মতিঝিল থেকে মিরপুরে যান মনির আহম্মেদ। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। বিকেল ৫টার দিকে নিউ ভিশন বাসে করে তিনি মতিঝিলে নামেন। বাসে কথা হয় তার সাথে।

তিনি জানান, সকালে মতিঝিলে নিউ ভিশনে উঠলে হেলপার আগেই যাত্রীদের উদ্দেশে বলেন আপনারা লোকাল যাবেন, না সিটিং যাবেন। সবাই বলেন লোকাল যাব। সে ক্ষেত্রে আগের ভাড়া ওই ২৫ টাকাই নিয়েছে। তবে কেউ কেউ জোর করে ২০ টাকা দিলে অনেক ঝগড়া হয় হেলপারের সাথে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একপ্রকার জোর করে ২০ টাকা দিয়েছি। তবে তার মতো দুয়েকজন ছাড়া সবার কাছ থেকে ২৫ টাকা নেয়া হয়। আবার প্রতিটি স্টপে যাত্রী ওঠানামা করছে। এতে সময় বেশি লাগছে। টাকাও বেশি আবার গাদাগাদি করে লোকজন যাচ্ছে।

বাস থেকে নেমে মতিঝিল শাপলা চত্বরে গিয়ে দেখা গেল বাসের জন্য অপেক্ষা করা মানুষ অনেকটা ক্লান্তির সাথে বিরক্তি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। এদের মধ্যে বেসরকারি চাকরিজীবী আবু আহম্মেদ বলেন, তিনি সকালে নাবিস্কো থেকে গাজীপুর পরিবহনে অনেক কষ্টে এসেছেন। ওই পরিবহন আগে সিটিং সার্ভিস ছিল। ভাড়া নিত ২০ টাকা। আজ নিয়েছে ১৮ টাকা। দুই টাকা কম নিলেও এত ভোগান্তি আগে কখনো হয়নি। যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা করে। কোনো শৃঙ্খলা নেই। এর আগে বেলা ৩টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে দেখা যায় বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন সাবেক ব্যাংকার আক্তার হোসেন। যাবেন সাভারে। ওই এলাকায় সদরঘাট, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল থেকে সাভার পরিবহন, স্বজন পরিবহন, ওয়েলকাম পরিবহন আসা-যাওয়া করে। রাস্তায় বাস চলাচল কম থাকায় যা আসছে তাও ভর্তি।

তিনি জানান, সকালে ওয়েলকাম পরিবহনে প্রেস ক্লাবের সামনে নেমেছি। আগের ভাড়া ৫০ টাকা নিয়েছে। তার প্রশ্ন লোকাল করে লাভ কী। আগেইতো ভালো ছিল। যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠাচ্ছে। একের ওপর অন্যরা ঠাসাঠাসি করে যাচ্ছে। এতে হেলপারদের আয়ের উৎস বেড়েছে। সাথে যাত্রীদের বেড়েছে হয়রানি। নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা প্রকাশ করে আক্তার হোসেন বলেন, গাড়ি ভর্তি লোক থাকায় পকেট মারেরও সুবিধা হয়েছে। কখন পকেটমার হয়ে যায় ভয়ে থাকি। সিটিং সার্ভিসই ভালো ছিল। ওই একই সময় দেখা গেল বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন কয়কজন নারী। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে বাস না পাওয়ায় অনেকটা বিরক্ত বোধ করছেন তারা। তাদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা মিরপুরগামী বাস ট্রান্সসিলভা আসামাত্রই উঠতে গিয়ে বেশ ঝক্কিঝামেলা পোহাতে দেখা গেল। বেশি ভিড় থাকায় ভোগান্তি উপেক্ষা করে কোনোমতে দাঁড়িয়েই যেতে দেখা গেল ওই মহিলাকে।

সাধারণ যাত্রীরা জানান, ওয়েলকাম পরিবহনে কলেজগেট থেকে উঠে ফার্মগেটে নামলেই ১৫ টাকা গুনতে হয়। ফার্মগেট থেকে উঠে শাহবাগ নামলেও ১০ টাকা, আবার মতিঝিল নামলেও ১০ টাকা গুনতে হচ্ছে। শুধু ওয়েলকামই নয়, আগের সিটিং সার্ভিসের সব বাসেরই একই চিত্র। অথচ লোকাল সার্ভিসের ভাড়ার হার হচ্ছে ৮ টাকা। একইভাবে শাহবাগ থেকে মতিঝিলে এলে আগের সিটিং সার্ভিসগুলোর ভাড়া ওই ১০ টাকা নেয়ারই অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ লোকাল সার্ভিসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত করা হয়েছে। এমনিভাবে সদরঘাট থেকে মিরপুর দুয়ারীপাড়া পর্যন্ত যায় বিহঙ্গ পরিবহন, মিরপুর ইউনাইটেড সার্ভিস, যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুরগামী বাস রয়েছে শিকড় পরিবহন, শিখর পরিবহন, খাজাবাবা পরিবহন, কেরানীগঞ্জ থেকে মিরপুর-১২ তে যায় সময় নিয়ন্ত্রণ ও চিড়িয়াখানা পর্যন্ত যায় দিশারী পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি বাস। গুলিস্তান থেকে আব্দুল্লাহপুর যায় তুষার এন্টার প্রাইজ, গুলিস্তান থেকে ছাড়ে মেঘলা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি বাস। মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুরে যায় দীপন পরিবহন, সিটি বাস, মৈত্রী, এফটিসিএল ও ধুপখোলা থেকে মোহাম্মদপুরে যায় মালঞ্চসহ বেশ কয়েকটি বাস। এদেরই বেশির ভাগই সিটিং সার্ভিস ছিল। এখন লোকাল সার্ভিস করা হলেও এদের বিরুদ্ধে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ীগামী বাস শিকড় পরিবহন, শিখর পরিবহন ও খাজাবাবা পরিবহনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাত্রীদের অভিযোগ, আগে শাহবাগ থেকে গুলিস্তান ৫ টাকা ও গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীতে ৫ টাকা নেয়া হতো। সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পরই লোকালের ভাড়া সর্বনিম্ন ৭ টাকা নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে বেশ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিয়ত যাত্রী-হেলপার বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগে কালশী মোড়ে গ্যালাক্সি পরিবহনের হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের বিতণ্ডার পর তিনি গাড়ি থেকে নেমে যান। এ অবস্থায় যাত্রীভর্তি বাসের চালকও হেলপার ছাড়া যেতে অস্বীকৃতি জানান। পরে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে ভাড়ার তালিকানুযায়ী ভাড়া আদায়ের মীমাংসা করলে বাসটি গন্তব্যে ছেড়ে যায়।