“ওরা সমাজের ছিন্নমূল”

কবি ও লেখক- হাসিনা মরিয়ম

তোমরা কি জানো
যারা তোমাদের চারপাশে
ঘুরে বেড়ায়…
আগাছার মতো-স্রোতের শেওলার মতো-
তাদের আমরা নাম দিয়েছি টোকাই,
তারা আমাদের শহরের জঞ্জাল- সমাজের ছিন্নমূল-

বাংলাদেশ তথা ঢাকা শহরে ছিন্নমূল বাস্তুহারা শিশু এবং মানুষের অভাব নেই। এদের জীবন বড়ই বৈচিত্রময়। ফুল বিক্রি বা টোকাই গিরি করে আর অন্যের কাছে হাত পেতে এদের জীবন চলে। এদের ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র পরের দিনের জন্য। এরা আমাদের সমাজের অংশ। এদেরকে আমরা বিভিন্ন নামে ডাকি। কেউ বলি পথশিশু, কেউ বলি টোকাই, কেউ আবার ছিন্নমূল বলে ডাকি। এদের বেশিরভাগ বাচ্চারা মায়ের সাথে থাকে, বাবা ছেড়ে চলে গেছে। এদের জীবন বলতে কোন কিছু খেয়ে বেঁচে থাকা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে ওরা বঞ্চিত। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এদের থাকার কথা ছিল খেলাধুলা আর পড়াশোনা নিয়ে। অথচ এদের জীবনযুদ্ধ চলছে ফুল বিক্রি করে আর অন্যের প্লেটের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে।

এই সব ছিন্নমূল বাস্তুহারা শিশুদেরকে দেখিয়ে কত নামকরা এনজিও কোটি কোটি টাকা অনুদান এনে ক্ষুদ্রঋণ নামক সুদের বিজনেস করে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, কিন্তু এদের কোন পরিবর্তন হয় নাই। যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেরারা নিয়ে যায়, কোন বিচার জবাবদিহির সম্মুখীন পর্যন্ত হতে হয় না। যে দেশে শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করতে সরকার শত কোটি টাকা ব্যয় করে ফেলে, সেই দেশে বড় লোকের ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট বিরানি আর মাংস ছাড়া হাড্ডি খাওয়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার। আসলে তাদের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। যাও করা হচ্ছে তার বেশিরভাগ ঐ লুটেরাদের পকেটে-পেটেই ঢুকছে। আমরা দুর্ভাগ্য জাতি আমাদের শিশুরা রাস্তায় ফুল বিক্রি করে তাদের পেটের আহার যোগাড় করতে হয়। এই সব শিশুরা কি রকম কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। তার খবর আমরা কয় জন রাখি।

বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। তারপরও কি এই ছিন্নমূল শিশুরা এমন করে ডাস্টবিন থেকে খাবার খাবে? আমাদের দেশে যত সমস্যা আছে তার মূল হল জনসংখ্যা সমস্যা। কেন এই সমস্যা নিয়ে কেউ কোন কথা বলেন না? আমরা ইচ্ছে করলেই এদের জন্য কিছু করতে পারি। যদি আমরা শিক্ষিতরা সপ্তাহে একদিন ২/৪ ঘন্টা এদের জন্য ব্যয় করি।

যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকাতে এরকম টোকাই বা পথশিশু ছিল অনেক দিন আগে। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষক উনাদের ছাত্রদের নিয়ে লন্ডন শহরে এই রকম বস্তির বাচ্চাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ শুরু করে ছিলেন যা এখনো চলছে এবং যুক্তরাজ্য সমাজে এখনও কেউ যদি স্বেচ্ছাসেবী কাজ না করে অন্যের জন্য, তাকে অনেক জায়গায় অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। এবং বিদেশীরা যুক্তরাজ্যের নাগরিক হতে হলে ২ বৎসরের স্বেচ্ছাসেবী কাজের অভিজ্ঞতা দেখাতে হয়। আমেরিকাতে এই পথশিশু বাচ্চাদের জন্য ১৯০৪ সালে বিগব্রাদার এবং বিগ সিস্টার নাম দিয়ে তাদেরকে কিভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায় শিক্ষা এবং কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে তা শুরু হয়েছিল নিউইয়র্ক শহরে এবং বর্তমানে চলছে মেন্টরি হিসেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩০ হাজারের মত ছাত্র/ছাত্রী এবং ২/৩ হাজারের মত শিক্ষক আছেন। এছাড়া ঢাকার অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো আছেই। ঢাকার সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী যদি সপ্তাহে একদিন ২ ঘন্টা এই বস্তির বাচ্চাদের জন্য  শিক্ষা এবং মেন্টর হিসেবে সময় দিলে ঢাকার বস্তির কোন বাচ্চা অশিক্ষিত থাকবে না। এবং ভবিষ্যতের জীবনের সুন্দর স্বপ্ন দেখতে পারবে। এদেরকে নিয়ে ভাল কিছু করা আমাদের দায়িত্ব। এদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্র, বিদেশী সাহায্য সংস্থা আর দেশের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিৎ।

এ সমাজে ওরা আমাদের মতই মানুষ এবং ওদেরও আছে অন্ন, বস্ত্র ও শিক্ষার অধিকার। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুর অন্তরে’। আজকের শিশু আগামী দিনের আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদ। আমরা যদি ওদের সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারি তবে হয়তো ওরাই বদলে দেবে দেশের ভবিষ্যৎ। তাই শুধু সরকার এগিয়ে আসলে চলবে না, এদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সমাজের সর্বস্তরের সব নাগরিকদের। একদিন দেশের এই সব ছিন্নমূল শিশুরা সচেতন মানুষদের সহায়তায় সুস্থ, স্বাভাবিক আলোকিত জীবনের সন্ধান পাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।