কলেরা রোগ কীভাবে ছড়ায় তা আবিষ্কার হয়েছিল যেভাবে

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

উনিশ শতকে যখন পৃথিবীর নানা দেশে লাখ লাখ লোক মারা যাচ্ছে কলেরা রোগে, তখন বিজ্ঞানীদের জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এই রোগ বিস্তারের রহস্য ভেদ করা।

চিকিৎসকরা তখন বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন যে এই রোগ কীভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়াচ্ছে। ভিক্টোরিয়ান যুগের মানুষ তখন মনে করত দুর্গন্ধময় বাতাসের মাধ্যমে কলেরা ছড়ায়।

ওই সময় জন স্নো নামে ব্রিটিশ একজন ডাক্তার প্রথম ধরতে পারেন যে কলেরার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত পানির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। তবে তার সেই তত্ত্ব প্রমাণের কাজ সহজ হয়নি।

ঘিঞ্জি পরিবেশ ও রোগব্যাধির বিস্তার
আঠারো শ’ পঞ্চাশের দশকে লন্ডন তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল স্তম্ভ। রানি ভিক্টোরিয়ার বিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু লন্ডন হওয়ার ব্যবসা বাণিজ্যের টানে লন্ডনের জনসংখ্যা তখন বাড়ছে দ্রুতহারে।

লন্ডনে বাসাবাড়িগুলো তখন মানুষে ঠাসা, শহরের পরিবেশ খুবই ঘিঞ্জি। ফলে অসুখবিসুখ ছড়াত গরীবদের মধ্যে বেশি।

ডা: জন স্নোর একটি জীবনীগ্রন্থে লন্ডনে বসবাসের চিত্র বর্ণনা করা হয় এইভাবে:

‘এক ঘরে গাদাগাদি করে থাকত পুরো পরিবার। চলত একইসাথে তাদের রান্না খাওয়া, ধোয়াধুয়ি, একই বাথরুম ব্যবহার, একই ছাদের নিচে ঘুমানো। সেখানে একবার কলেরা ঢুকলে তা ছড়াত দ্রুত। অনেক বাড়ি ছিল যেখানে এক ঘরে কয়েকটি পরিবার বাস করত এক সাথে।’

ডা: স্নো এবং ওইসময় আরো অনেকেই লন্ডনে এভাবে মানুষের বসবাসের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন।

তবে ১৮৪০ এবং ১৮৫০-য়ে যখন কলেরার প্রাদুর্ভাব হয়, তখন জন স্নো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় লক্ষ্য করেন, যার উল্লেখ আছে তার এই জীবনী গ্রন্থে ।

‘যারা অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশে থাকে তাদের মধ্যে কলেরা হলে সেটা পরিবারের এক সদস্য থেকে আরেকজনে ছড়ায় না। কিন্তু যেখানে সবাই সারাক্ষণ একই বেসিনে হাত ধুচ্ছে, একই তোয়ালেতে হাত মুছছে, একই জায়গায় রান্না খাওয়া করছে, সেখানেই রোগ ছড়াচ্ছে দ্রুত।’

এটা লক্ষ্য করার পর জন স্নো-র দৃঢ় ধারণা জন্মায় যে কলেরা বাতাস বা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে না। কলেরার জীবাণু অন্য কোনোভাবে শরীরে ঢুকছে। বিবিসিকে বলেন আমেরিকায় মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির হিউমান মেডিসিনের অধ্যাপক ড. নাইজেল প্যানেথ, যিনি জন স্নোর একজন জীবনীকার।

ইংল্যান্ডে মড়ক
এই ভয়ঙ্কর রোগ ইংল্যান্ডে প্রথম ধরা পড়ে ১৮৩০-এর দশকে।

কলেরা ১৮৩০ থেকে ১৮৫০-য়ের দশক পর্যন্ত ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে।

মধ্য এশিয়ার তাসখান্দ থেকে শুরু করে ইউরোপে মস্কো, পোল্যান্ডের ওয়ারস, প্যারিস নানা দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব যেভাবে ছড়িয়েছিল, তাতে লন্ডনের মানুষ তখন আতঙ্কে দিন কাটাত কখন এই রোগ লন্ডনে হানা দেবে।

এই সময় মানুষ শুধু এটুকুই জানত যে, কলেরায় আক্রান্ত হলে মৃত্যু ঘটবে দ্রুত। প্রায়শই আক্রান্ত হবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।

নাইজেল প্যানেথ বলেন ডায়রিয়া কী মানুষ জানত, কিন্তু কলেরার অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। কলেরা ছড়ানোর পর আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ প্রথম জানল এই রোগের উপসর্গগুলো কী।

‘হয় প্রবল ডায়রিয়া, নয় বমি- যেন শরীর থেকে সবকিছু বেরিয়ে আসছে। অনেক মানুষ আক্রান্ত হবার চার ঘণ্টার মধ্যে জলশূন্যতার কারণে মারা যেত। শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি বেরিয়ে যেত।

‘অনেক সময় দেখা যেত মল নয়, শুধু ঘোলাটে পানি বেরিয়ে আসছে শরীর থেকে। আর শরীর থেকে নির্গত ওই জলীয় পদার্থ ছিল ভয়াবহ রকমের সংক্রামক,’ বলেছেন প্যানেথ।

কিন্তু কীভাবে সেই সংক্রমণ ছড়ায় সে সম্পর্কে কারো সঠিক কোনো ধারণা ছিল না।

কোনো কোনো বিজ্ঞানী শুধু একটু বুঝেছিলেন যে এই রোগের জীবাণু একজন মানুষ থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে তা ঘটছে সেই তত্ত্ব ৩০ বছর পর্যন্ত কেউ প্রমাণ করতে পারেননি।

কলেরা ছড়ানো নিয়ে বিভ্রান্তি
কোনোরকম তত্ত্ব প্রমাণের চেষ্টার বদলে লন্ডনের স্বাস্থ্য বোর্ড তখন বলতে শুরু করে যে শহরের দূষিত বাতাসই কলেরা ছড়ানোর কারণ এবং মানুষও সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করে।

এমন একটা তত্ত্ব ছড়ায় যে কলেরা রোগীদের নিয়ে জাহাজ এসে থামছে বন্দরে আর আক্রান্তদের শরীর থেকে নির্গত পচা গ্যাস বায়ু বাহিত হয়ে শহরে ঢুকে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।

গ্যাসের ওই তত্ত্ব পরিচিত ছিল মায়ায্-মা নামে। বলা হতো সবরকম রোগ জীবাণুর কণিকা পচা তরিতরকারি, মাংস, মল এবং ঘোড়ার বিষ্ঠার দুর্গন্ধময় গ্যাসের মধ্যে বেঁচে থাকে আর লন্ডন শহরের বাতাস ওইসময় যেহেতু ছিল দুর্গন্ধময় গ্যাসের দূষণের শিকার, ফলে এমন ধারণা জন্মায় যে এই পচা গ্যাসের মধ্যে থাকা জীবাণু থেকে শহরে কলেরা ছড়াচ্ছে।

লন্ডনের স্বাস্থ্য বোর্ড তখন টেমস নদীর ওপর বাতাসের চাপ পরীক্ষা করে দেখতে যে পচা গ্যাস আর কলেরা ছড়ানোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা।

জন স্নো কিন্তু বিশ্বাস করেননি যে, কলেরার জীবাণু ছড়ানোর কারণ শহরের দূষিত বাতাস।

পেশায় চিকিৎসক হলেও ডা: স্নো বাতাস ও গ্যাসের প্রবাহ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। এমনকি চিকিৎসায় অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি তখন অ্যানাসথেশিয়া বা চেতনানাশক ওষুধও তৈরি করেছেন।

প্রথম সূত্র
এরই মধ্যে কলেরা মহামারীকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ ডা: স্নো পেলেন ১৮৩০ সালে। তিনি তখন ১৮ বছর বয়সী ডাক্তারির ছাত্র। শিক্ষানবীশ হিসাবে তাকে কলেরা রোগীদের চিকিৎসার জন্য পাঠানো হল উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডে এক কয়লাখনি এলাকায়।

তার জীবনীকার নাইজেল প্যানেথ বলছেন, সেখানে যাওয়াটা তখন ছিল খুবই ভয়ের। কারণ এই রোগে প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছে।

‘কেউ জানে না কীভাবে রোগ ছড়াচ্ছে, কীভাবে রোগ ঠেকানো সম্ভব। স্নো দেখেছিলেন খনি এলাকা থেকে প্রচুর লাশ বের করে আনা হচ্ছে। অভিজ্ঞতাটা ভয়ের হলেও তিনি কিন্তু সেখানেই এই রোগ ছড়ানোর কারণটা প্রথম ধরতে পারেন।’

খনি এলাকায় এই রোগ প্লেগের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটেনে কলেরায় সবেচয়ে বেশি মারা যায় খনি শ্রমিকরাই।

স্নো শ্রমিকদের কাজের ধারার ওপর নজর রাখেন এবং দেখেন শ্রমিকরা অনেকটা সময় কাটায় কয়লাখনির ভেতরেই।

‘তারা খনির ভেতর সাথে করে নিয়ে যেত যথেষ্ট পরিমাণ খাবারদাবার। ভেতরে তারা অবশ্যই হাত না ধুয়েই খাবার খেতো, আর খেতো হাত ব্যবহার করে।’

জন স্নো বুঝেছিলেন শৌচকর্ম করে হাত না ধোয়ার কারণে মলের ভেতর থাকা কলেরার জীবাণু অসাবধানে একজন মানুষের শরীর থেকে আরেকজন মানুষের শরীরে ঢুকছে এবং সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।

তত্ত্ব প্রমাণে পানির কল
তার এই তত্ত্ব প্রমাণের চেষ্টা জন স্নো করলেন যখন ১৮৫৪ সালে ব্রিটেনে কলেরা আবার মহামারী আকারে দেখা দিল। ওই বছর ব্রিটেনে কলেরার মড়ক ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। শুধু লন্ডনেরই ছোট্ট একটা এলাকা জুড়ে মাত্র তিনটি রাস্তায় দশ দিনে কলেরায় মারা যায় ৫০০ লোক।

জন স্নো সরকারিভাবে স্বাস্থ্য বোর্ডের সদস্য না হলেও, তিনি তার তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলেন।

লন্ডনের ওই মড়ক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন ওই প্রার্দুভাবের সাথে জড়িত রয়েছে পাড়ার একটি পানির কল।

জন স্নো তার গবেষণা পত্রে লিখেছিলেন, সেখানে গিয়ে আমি দেখলাম যারা মারা গেছে তারা প্রায় সবাই ওই পানির পাম্পের কাছেই থাকেন। ওখান থেকেই স্থানীয়রা সবাই ধোয়াধুয়ি, রান্না আর খাওয়ার জন্য পানি সংগ্রহ করেন।

গবেষণায় পরে জানা যায়, একটি বাসার মাটির নিচে পয়ঃনিষ্কাশন বর্জ্যের ভাগাড় থেকে চুঁইয়ে সেখানকার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে একটা কুয়াতে, যেখান থেকে ওই কলে পানি আসে।

কিন্তু ডা: স্নো লিখেছেন, বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ওই পাম্পের কাছেই ছিল একটি মদের ভাটি। সেখানকার কোনো কর্মী কিন্তু কলেরায় আক্রান্ত হয়নি।

‘ভাটির কর্মীরা আক্রান্ত হয়নি শুনে আমি সেখানে গেলাম। মালিক হগিন্সের সাথে দেখা করলাম। শুনলাম সেখানে ৭০ জনের মতো লোক কাজ করেন। হগিন্স বললেন, সেখানে প্রত্যেক কর্মীর জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ মদের বরাদ্দ থাকে। তার কর্মচারীরা পিপাসা পেলে পানি খায় না, বরং বিনা মূল্যে পাওয়া মদ পান করে তেষ্টা মেটায়।’

অর্থাৎ ওই পাম্পের পানি তারা একেবারেই খায়নি, ফলে কলেরায় আক্রান্তও হয়নি। নাইজেল প্যানেথ বলছেন ডা: স্নো তার এই তত্ত্ব প্রমাণের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করেছেন।

‘এমনকি এই তত্ত্ব নাকচ করে দিতে পারে এমন উদাহরণও তিনি সবসময় খুঁজেছেন। কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেখেছেন তার তত্ত্বই সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।’

এবার অকাট্য প্রমাণ
অবশেষে তার কাছে এই তত্ত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণ করার সুযোগ এল যে, শুধু দূষিত পানি নয়, রোগজীবাণু সংক্রমিত পানিই কলেরা ছড়ানোর একমাত্র কারণ।

দক্ষিণ লন্ডনে একটি এলাকার সন্ধান তিনি পেলেন যেখানে কলের পানি সরবরাহ করে দুটি আলাদা কোম্পানি। প্রথম কোম্পানির পানির উৎস হল টেমস নদী যেখানকার পানির সাথে পয়ঃনিষ্কাশনের বর্জ্য মিশছে। আর দ্বিতীয় সংস্থাটির পানি আসছে পরিশুদ্ধ উৎস থেকে।

তিনি দেখলেন ওই এলাকায় যে ৪৪ জন কলেরায় মারা গেছে, তাদের প্রত্যেকের বাসায় পানি আসত টেমসের ওই উৎস থেকে।

প্যানেথ বলছেন জন স্নো এরপর ওই এলাকার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখালেন যে প্রথম কোম্পানিটি থেকে যাদের বাসায় পানি যাচ্ছে তাদের কলেরায় মৃত্যুর আশঙ্কা ১৪ গুণ বেশি।

‘বাসাগুলো কিন্তু একই পাড়ায়, একই রাস্তায়, পাশাপাশি। তফাৎ শুধু-কেউ পানি পাচ্ছে টেমসের উৎস থেকে, কেউ অন্য সংস্থাটি থেকে। তারা নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিন্তু একই বাতাসে। কাজেই তিনি বললেন, বাতাসকে এখানে দায়ী করব কোন যুক্তিতে?’

জন স্নো এর দু বছর পর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

ব্রিটেনের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বোর্ড মৃত্যুর পর তার তত্ত্বকে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি দেয়। ডা: স্নো সেটা শুনে যেতে পারেননি। লন্ডনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থারও এরপর সংস্কার করা হয়-সেটাও দেখে যেতে পারেননি তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখনো পৃথিবীতে প্রতিবছর ৪০ লাখ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়, যা নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে ঠেকানো সম্ভব।

প্যানেথ বলছেন ডা: স্নো কলেরা ছড়ানোর কারণটা সঠিকভাবে ধরতে পেরেছিলেন।

মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়ানোর পথ খোঁজার জন্য তার নিরলস প্রয়াস মহামারী বিষয়ে গবেষণার পথ খুলে দিয়েছিল।

মানুষ প্রথম ভাবতে শিখেছিল, যে কোনো সংক্রামক রোগের মহামারী ঠেকানোর মূল উপায় সংক্রমণ কীভাবে ছড়াচ্ছে সেটা চিহ্ণিত করা।
সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস