“জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার”

হাসিনা মরিয়ম

প্রতিটি বাঙালী ললনার পছন্দের পোশাক শাড়ী। শাড়িতে একজন বাঙালী নারীর ব্যক্তিত্ব যেভাবে ফুটে উঠে আর কোন পোশাকে সেই অর্থে ফুটে উঠে না। আর সেই শাড়ী যদি নজর কাড়া কারুকাজ সমৃদ্ধ হয় তবেতো কথাই নেই।

"জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার"হ্যা আমি জামদানি শাড়ীর কথাই বলছি। আমাদের ঐতিহ্য আমাদের অহংকার জামদানি শাড়ী। জামদানি শাড়ীর আবেদন মেয়েদের কাছে আজও অমলিন। এটাই জামদানির যাদু। এর বুননশৈলী ও সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এর  সঙ্গে বাঙালীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সম্পর্ক আদি কালের।

জামদানি শিল্প বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শিল্প বাংলাদেশের অহংকার। শিল্পের ভিতরে যে ঐশ্বর্য ছড়িয়ে আছে তা আমাদের ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আজও জনপ্রিয়তার অনন্য হয়ে আছে।  একসময় মসলিনের পরিপূরক হয়ে আমাদের ঐতিহ্যে বসতি গেড়েছিল জামদানি। ক্রমেই তা বাংলার নারীদের আপন মমতায় আর সুনিপন দক্ষতায় হয়ে উঠে ঐতিহ্যের পাশাপাশি আভিজাত্যের পোশাক।

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর বাঙালী গর্বের মাস।দীর্ঘ রক্তক্ষয়ের  মাঝে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের অহংকার।

"জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার"এই ডিসেম্বরেই জাতির জন্য আরো একটি বড় অর্জন আছে, যার সঙ্গে এই বুনন শিল্প জড়িত। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জামদানির মেধাস্বত্বের(ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) স্বীকৃ্তি দেওয়া হয়।

"জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার"

ইউনেস্কো কমিশনের অষ্টম অধিবেশনে “কনভেনশন ফর দা মেকগার্ডিং অব দ্য ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ” বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। বিজয়ের মাসে এমন একটি স্বীকৃ্তি পাওয়া নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গৌ্রবের। দেশীয় কোন অনুষ্ঠান হউক বা আন্তর্জাতিক বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন পোশাকের কথা ভাবতে গেলে সবার আগে যে নামটি আসে, সেটি হল জামদানি শাড়ী।

"জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার"কোন পোশাকেই বাংলাদেশকে সেভাবে তুলে ধরতে পারেনা যেটা শুধু জামদানি পারে। এর সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য ও কৃ্ষ্টি জড়িত। তাছাড়া ফ্যাশন বা আভিজাত্যের কথা যদি বলি, তাহলেও আমাদের কাছে জামদানি উপরে আর কিছুই নেই।

একজন বাঙালী নারীর এর চেয়ে অভিজাত পোশাক আর কিছুই হতে পারে না।

 

 

জামদানি বিখ্যাত ছিল তার বিচিত্র নকশার কারণে। প্রতিটির নকশার "জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার"আছে ভিন্ন ভিন্ন নাম যেমন পান্নাবাহার, বুটিদার, দুবলিজাল,তেরসা,ঝালর,ময়ুর পাখা, কলমিলতা,পুইলতা, কল্কাপাড়,কচুপাতা,আঙ্গুরলতা এবং প্রজাপতি প্রভৃতি নানারকম নামে সমৃদ্ধ জামদানির নকশা, মূলত যুগের সাথে সাথে জামদানির নকশায়ও হালকা পরিবর্তন এসেছে। তবে জামদানির আসল চেহারা হারায়নি। পাল্টায়নি এর বুনন কৌশলও যেমন প্রাচীন আমলে ফুলের মোটিফের নকশা বেশী দেখা যেত। পরে কানবালা ছোটবুটি, বরফি নানারকম নকশা যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে জামদানিতে আদি মোটিফগুলোই ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গেই খুব সামান্যই ভিন্ন মোটিফ ব্যবহৃত হয়। যা জামদানির ঐতিহ্যবাহী মোটিফের ভিন্ন মাত্রা।

 

রংয়ের মাঝে বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে হালকা রং। তবে সময় অনুযায়ী রংয়েরও তারতম্য ঘটে যেমন শীতে গাঢ় রং, গরমে হালকা রং, বৈশাখে লাল সাদা ইত্যাদি।

সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতেও শতাধিক পন্য বাংলা থেকে ইউরোপিয়ানরা হামবুর্গ,লন্ডন, মাদ্রিদ, কোপেনহেগেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠাতো। যার মধ্যে জামদানিই সর্বাধিক সমাদৃত ছিল। এক সময় শুধুমাত্র গজ কাপড় হিসেবে বোনা হলেও পরবর্তীতে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে জামদানি শাড়ীতে। বর্তমানে সালোয়ার,কামিজ,ফতুয়া ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে।

"জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার"প্রাচীন কাল থেকে এই ধরনের কাপড় তৈরীর জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের পুরাতন সোনারগাঁ বিখ্যাত। বর্তমানে রুপগঞ্জ,সোনারগাঁ,সিদ্ধিরগঞ্জে প্রায় ১৫৫টি গ্রামে এই শিল্পের বর্তমান নিবাশ। প্রাচীন সময়ে জামদানি বুননে একমাত্র মুসলিম কারিগররাই ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।এখনো মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকই এই শিল্পের দক্ষতার সঙ্গে জড়িত।

অর্জন যে সময়েই হউক, তা নিঃসন্দেহে আনন্দের, তবে ডিসেম্বর মাসের সঙ্গে আমাদের এমন বিজয়গাঁথা জড়িত যে একসময় যে কোন অর্জনে আনন্দের মাত্রা যেন দ্বিগুণ হয়ে যায় তা সে যে ক্ষেত্রে হোক না কেন। বিজয়ের মাসে জামদানির মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের অর্জনের আনন্দকে তাই আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

"জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে, আমাদের অহংকার"এই কৃ্তিত্ব তাদের যারা এই শিল্পের চর্চাকে বিশ্বের দরবারে পৌছে দিয়েছেন। এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যে আমাদের অহংকার জামদানি শিল্প। জামদানি আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ, বাংলাদেশের জামদানি শিল্প কোন আরোপিত শিল্প নয়। হাজার বছর ধরে বাংলাদেশে জামদানি তৈরী হচ্ছে। বাঙালী নারী এবং জামদানি শাড়ী আবহমান কাল থেকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বহু বাধা অতিক্রম করে জামদানি তার ঐতিহ্যে রক্ষা করে টিকে আছে। বিদেশের মাটিতে জামদানি তার জায়গা করে নিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে জামদানি শাড়ীর চাহিদা ততই বৃ্দ্ধি পাচ্ছে। এই শিল্প দেশের সম্মান ও সম্পদ বয়ে আনছে। কালের বিবর্তনে জামদানি তার নিজস্বতা হারায়নি, অনন্য হয়ে আছে আপন বৈশিষ্ট্যে, সবার মাঝে এই জনপ্রিয় শিল্পটি যুগযুগ ধরে টিকে থাকবে এবং বয়ে আনবে দেশের জন্য সম্মান। জামদানি আমাদের ঐতিহ্যে আমাদের অহংকার।

বাঙালী এবং জামদানি পাশাপাশি চিরন্তন হয়ে বেঁচে থাকবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।