জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ চান্দা বিলের রয়েছে অপার সম্ভাবনা

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

দেশে যত বিল, বাওড়, হাওড় বা জলাভূমি আছে তার মধ্যে জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ অন্যতম গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার চান্দা বিল। এই বিল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ছয়টি মৌজা নিয়ে বিল চান্দার অবস্থান থাকলেও একে ঘিরে রয়েছে ২৭টি গ্রাম। বর্তমানে রয়েছে অপার সম্ভাবনা, চান্দার বিলের নামকরণেও রয়েছে নানান কল্পকাহিনী।

কতদিন আগে চান্দা বিলের জন্ম হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও সুন্দরবনাঞ্চল অধ্যুষিত এ এলাকায় ধারণা করা হয় এক সময় সুন্দরবন ছিল। কালেরগর্ভে প্রাকৃতিক দূর্যোগে বা ভূমিকম্পে বনাঞ্চল ধ্বসে বিলের সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেক মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। কারণ চান্দার মাটিতে প্রচুর পিট কয়লা সেই ইঙ্গিত বহন করে।

নামকরণের যত কল্পকাহিনী রয়েছে তার মধ্যে গ্রহণযোগ্য হলো, মোঘল আমলে দক্ষিণ বাংলার বিখ্যাত ব্যবসায়ী চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় দৈবাত মালামাল বোঝাই সাতটি নৌকা নিমজ্জিত হওয়ার পরই এই বিলের নাম বিল চান্দা নামকরণ হয়েছে।

চান্দা বিল এলাকায় কয়েক বছর আগেও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। দুটি গ্রামে এখনো নৌকার মাধ্যম ছাড়া চলা যায় না। এই বিলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার।

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই বিলে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ, পাখি, অতিথি পাখি, শাপলা ফুল, পিট কয়লা, কচুরীপানা, শেওলা, কেচো, পদ্মফুল, কলমীশাক, হিনচা শাক, পানি লজ্জাবতীগাছ, নল খাগড়া ইত্যাদি নাম না জানা প্রজাতির গাছ পালা জীবজন্তু।

জীব বৈচিত্রের আধার ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই বিলের উল্লেখযোগ্য সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:

মাছ : চান্দার বিলের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাছ অন্যতম। এখানে প্রায় দেড় শ’ প্রজাতির মাছ এখনো বিদ্যমান। জলিরপাড় ইউপি চেয়ারম্যান মিহির কান্তি রায় জানিয়েছেন, প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার মোট চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ মাছ বিল চান্দা থেকে সরবরাহ করা হয়। এই মাছ ধরা, বিক্রি করা, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে কর্মসংস্থান করে জীবিকা নির্বাহী করে প্রায় আট হাজার পরিবার। এখন প্রতিদিনই ধরা পড়ে কৈ, শিং, শোল, গজার, দেশী সরপুটি, রুই কাতলা, মাগুর, টাকি, পুটি, বাইন, টেংরা, মলা-ঢেলা অসংখ্য প্রাকৃতিক মাছ ছাড়াও সরকারি অনুদানে উন্মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা হাইব্রিড জাতের মাছ।

পিট কয়লা : চান্দা বিলে স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক সম্পদ হলো পিট কয়লা। নিম্নাঞ্চলের এখনো প্রায় এক হাজার পরিবারের একমাত্র আয় পিট কয়লা আহরণ করে বিক্রি করা। ক্রেতারা ওই শুকনো কয়লা দিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুত চুলায় রান্না করে। এই চুলায় পরিবেশ দূষণ অর্থাৎ ধোঁয়া হয় না বলে অনেক রাঁধুনী পিট কয়লা ব্যবহার পছন্দ করেন।

শাপলা ও শালুক : নিম্নঞ্চল বা উচ্চ এলাকার লোকদের কাছে বর্ষাকালীন সবজী হিসেবে শাপলা বহুল ব্যবহৃত। বিল চান্দার আশপাশের গ্রামবাসীরা বর্ষা মৌসুমে শাপলা সবজি হিসেবে খায়। গোপালগঞ্জ, খুলনা, ঢাকা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ হাট বাজারে শাপলা সবজি হিসেবে বিক্রি হয়। এতে বিল চান্দা এলাকার এক হাজার পরিবার শাপলা বিক্রির সাথে জড়িত। আশ্বিন-কার্তিক বা অক্টোবর নভেম্বর মাসে শাপলা গোড়ার পানি কমে গেলে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী শাপলা গাছের গোড়ায় যে গোটা অংশ থাকে তাকে শালুক বলে। শালুক একটি সুস্বাদু খাবার।

শামুক : প্রাকৃতিক ভারসাম্য, চান্দার বিলের বর্ষা মৌসুমে শামুক এখন অর্থকরী পণ্য, চান্দার বিল এলাকায় বড়-বড় সাইজের শামুক খুলনা এলাকায় চিংড়ি ঘেরে বিক্রি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে চান্দার বিলের পার্শ্ববর্তী সড়কের পাশে প্রতিদিন বসে শামুক বিক্রির হাট। জলিরপাড়, কলিগ্রাম, রাঘদী, উজানী, রাহুথড়, বেদগ্রাম, মোচনা এলাকা থেকে প্রতিদিন ৮/১০ ট্রাক ছাড়াও বিল রুট ক্যানেলে নৌকা ভিড়িয়ে কয়েকটি ট্রলারযোগে খুলনা বাগেরহাটসহ বিভিন্ন চিংড়ি চাষ এলাকায় শামুক চলে যায়। এই শামুক খাওয়ার জন্য প্রচুর অতিথি পাখিও আসে।

শ্যাওলা : চান্দা বিলের উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুরসহ নিম্নাঞ্চলের অপার প্রাকৃতিক সম্পদ শ্যাওলা। আগে কোনো কাজে না লাগলেও বর্তমানে শ্যাওলা মূল্যবান পণ্যে রূপান্তর হয়েছে। মাছের উৎকৃষ্ট খাদ্য শ্যাওলা।

পানি ফল ও পদ্মফুল : পানি ফল ও পদ্মফুল জলজ উদ্ভিদ থেকে উৎপাদিত ফসল। পদ্মফুল থেকে মৌমাছির সংগৃহীত মধু পদ্মমধুর উপকারিতা অনেক। ওই পদ্মফুল বিভিন্ন পূজা অর্চনাতেও ব্যবহৃত হয়। এটারও অনেক ওষুধিগুন রয়েছে। যত্ন ও তত্ত্বাবধানের অভাবে পদ্মফুল বিলুপ্ত প্রায়।

শাক : বিলের পানিতে হিচনা শাক ও কলমি শাক খুবই জনপ্রিয়। পুষ্টিকর ও ওষুধি গুন সম্পন্ন শাক। বিলে প্রচুর পরিমাণ শাক উৎপন্ন হয়।

ধান : চান্দা বিলের এলাকার একটু অপেক্ষাকৃত উচু জমিগুলোতে বোনা হয় টেকসই বিভিন্ন প্রজাতির ধান। এর মধ্যে দিঘা ও শাইল জাতের ধানই বেশি। দিঘার আরো কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। দিঘার ধানের ঢেঁকি ছাঁটা চাল এখন অমূল্য সম্পদ। এটা গ্রামেও অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বেশি পানিতে জন্মানো শালিধানের বিভিন্ন প্রজাতির ধানে ভাত ছাড়াও সুস্বাদু মুড়ির ধান জন্মে এই বিলে।

৬০ দশকে স্থানীয় লোকজন ভাবত এলাকাটি অভিশপ্ত। এখন এসব প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে পাল্টে যেতে পারে ওই এলাকাসহ সারা দেশের জীবনযাত্রা। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে পারলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও রক্ষা হবে। জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ করা যাবে।

সূত্র : বাসস

বিডিসংবাদ/এএইচএস