তেলের উৎপত্তির সাথে কি ডাইনোসরের সংযোগ আছে?

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

আজকের সমাজের মূল চালিকাশক্তি হলো তেল। এই তেলের দখল নিয়ে বিশ্বে যুদ্ধ বেঁধেছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যও প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হয় তেলকে।

বিশ্বে প্রতিদিন আট কোটি ব্যারেলেরও বেশি তেল উৎপাদিত হয়। এই তেলকে ‘পেট্রোলিয়াম’ বলা হয়ে থাকে। পেট্রোলিয়াম শব্দটি ল্যাটিন শব্দ পেত্রা এবং ওলিয়াম থেকে এসেছে।

পেত্রা অর্থ পাথর এবং ওলিয়াম অর্থ তেল। সে হিসেবে পেট্রোলিয়াম বলতে বোঝায় পাথর বা মাটি খুঁড়ে উত্তোলন করা তেল।

এই অপরিশোধিত থকথকে কালো তেল ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ বা ‘কালো স্বর্ণ’ নামেও পরিচিত।

থকথকে তেলটি মূলত হাইড্রোকার্বনের মিশ্রণ। এটি এমন এক যৌগ, যার আণবিক গঠনে প্রধানত কার্বন এবং হাইড্রোজেন থাকে।

তেল হলো এমন একটি উপাদান যা লাখ লাখ বছর ধরে রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে একপর্যায়ে তেলে রূপ নেয়।

কিন্তু এই তেল কোথা থেকে আসে?

এক্ষেত্রে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী একটি তত্ত্বের পক্ষে কথা বলেন, তাদের দাবি তেলের উৎস কী এটা সহজেই বুঝা যায়।

কিন্তু এই তেলের উৎস নিয়ে আজও নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন রয়েছে।

ডাইনোসরের মিথ
ধারণা করা হয়, আজকের অপরিশোধিত তেল মজুদের প্রায় ৭০ শতাংশ মেসোজোয়িক যুগে গঠিত হয়েছিল, যা ২৫ কোটি ২০ লাখ থেকে ছয় কোটি ৬০ লাখ বছর আগের কথা।

মেসোজোয়িক যুগ ট্রায়াসিক, জুরাসিক এবং ক্রিটেসিয়াস যুগে বিভক্ত, এটি সরীসৃপের যুগ হিসাবেও পরিচিত এবং ডাইনোসররা এই যুগেই সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল।

এই যুগই সম্ভবত ব্যাখ্যা দিতে পারবে কেন এ সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল।

অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রিডার মুলার সায়েন্স-নরওয়েকে বলেন, ‘কিছু অদ্ভুত কারণে, অনেকেরই ধারণা যে ডাইনোসর থেকে তেল আসে। কিন্তু তেল মূলত আসে কোটি কোটি ক্ষুদ্র শৈবাল এবং প্ল্যাঙ্কটন থেকে।’

এই পৌরাণিক ধারণার জন্ম কিভাবে হয়েছিল সেটা নিশ্চিতভাবে কেউ জানে না, তবে এই গল্প ল্যাটিন আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

বিবিসি মুন্ডো দুই মেক্সিকান বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তারা এই বিশ্বাস সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা।

এ বিষয়ে, ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকোর ভূতত্ত্ব অনুষদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক দারিও সোলানো এবং ইজা ক্যানালেস বলেছেন, ‘এটি বহুল প্রচলিত ধারণা হলেও, ধারণাটি ভুল।’

সোলানো বলেন, ‘অন্তত এই সময়ে এসে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি, হাইড্রোকার্বন তৈরি করে এমন অনেক শিলা জুরাসিক স্তরে পাওয়া গেছে, জুরাসিক যুগ হলো ডাইনোসরের ভূতাত্ত্বিক সময়কাল এবং সম্ভবত এই কারণে ডাইনোসর থেকে তেল আসার ভ্রান্ত ধারণাটি প্রচলিত হয়েছে।’

‘এই পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে ভুল প্রমাণ করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে, প্রথমত যে পদার্থটি বেশ পরিচিত এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে, সেটি সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করা প্রয়োজন।’

দ্বিতীয়ত, এই পদার্থের মূল উৎস বা ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখলে এ সংক্রান্ত আধুনিক প্রযুক্তি বা এর ব্যবহারকে আরো সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে,’ এমনটাই বলছেন ক্যানালেস।

কিভাবে তেল গঠিত হয়?
তেলের উৎপত্তির পেছনে মূল উৎস বড় কোনো সরীসৃপ নয়, বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী।

তেলের উৎস সম্পর্কে সর্বাধিক স্বীকৃত তত্ত্ব হলো- এটি সমুদ্র এবং হ্রদগুলোর তলদেশে জমে থাকা প্রাণী এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শৈবাল পচে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে।

এই তত্ত্বটি নির্দেশ করে যে- সূক্ষ্ম পলিদানাসহ বিভিন্ন জৈব পদার্থ বিশেষ করে, স্থলজ বা সামুদ্রিক উদ্ভিদ নদী অববাহিকায় জমা হয়।

নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ার পরে, কেরোজেন গঠিত হয়, যা নানা ধরনের জৈব পদার্থের মিশ্রণ এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাপ ও চাপ বৃদ্ধি পেতে পেতে একপর্যায়ে হাইড্রোকার্বন চেইন গঠন করে, ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকোর বিজ্ঞানীরা এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

জৈব পদার্থগুলোর উপরে অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক স্তরগুলো জমতে জমতে চাপ এবং তাপ বাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা অ্যানেরোবিক ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এতে ধীরে ধীরে জৈব পদার্থগুলো অল্প পরিমাণে অন্যান্য উপাদানের সাথে মিশে হাইড্রোকার্বনে রূপ নেয়।

‘সহজভাবে বললে, বিষয়টা অনেকটা সব উপাদানকে এক করে সেগুলো প্রেশার কুকারে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করার মতো (অর্থাৎ যেখানে চাপ এবং তাপের সৃষ্টি হয়)। যতক্ষণ না আসল পদার্থটি কার্বন এবং হাইড্রোজেনের চেইনে ভেঙে যায়।’

মাটির নিচের স্তরেও একই রকম কিছু ঘটে। এতে ওই উপাদানগুলো শিলা থেকে রূপান্তরিত হতে থাকবে এবং তেল হয়ে মাটির নিচে জমা হতে থাকবে,’ মেক্সিকান বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন।

এই তত্ত্বটি সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত কারণ সমস্ত তেলের মজুদ পাললিক ভূখণ্ডে পাওয়া গেছে। উপরন্তু, তারা প্রাণী এবং উদ্ভিদের জীবাশ্মের অবশিষ্টাংশের সন্ধানও পেয়েছেন।

তেলের শক্তি কোথা থেকে আসে?
পুরনো বনভূমির জৈব উপাদানের রূপান্তর থেকেও তেল আসতে পারে।

জৈব তত্ত্বে একটি বিষয় পরিষ্কার যে- যেকোনো ধরনের পদার্থে জৈব উপাদান থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, স্থলজ উদ্ভিজ পদার্থ থেকে কেরোজেন উৎপন্ন হয় এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত হাইড্রোকার্বন গ্যাস থেকে তেল জমতে থাকে, মেক্সিকান বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন।

এ নিয়ে আরেকটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে, যা বিষয়টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারে। সেটি হলো- ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বা উদ্ভিদের ক্ষুদ্রাংশ কি তেলের শক্তি এবং সৌর শক্তির সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে জু্ওপ্ল্যাঙ্কটন বা প্রাণীর ক্ষুদ্রাংশে রূপান্তর হতে পারে?

‘না, এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা,’ ক্যানালেস বলেছেন।

‘আজ তেল থেকে আমরা যে শক্তি পাই, তা হাইড্রোজেন এবং কার্বন চেইনের (হাইড্রোকার্বন) জারণ (দহন) থেকে পাওয়া যায়।’

‘এটি সত্য যে শক্তি এবং পদার্থ পরস্পরকে ধারণ করতে পারে। আরো সহজ করে বললে, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন এবং জুওপ্ল্যাঙ্কটন অনেকটা সৌর ব্যাটারির মতো। আপনি বরং একে একটি এনালগ সিস্টেম হিসাবে ভাবতে পারেন যে- মানুষ কিভাবে খাবার খায় এবং সেই খাবার আমাদের পরিপাকতন্ত্রে গিয়ে অক্সিডেশন প্রক্রিয়া বা হজমের মাধ্যমে কিভাবে ভেঙে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আমাদের শরীরের কোষগুলো এই শক্তি বা খাবারের উপাদানগুলোর উপকারিতা নিতে পারে বলেন, সোলানো।

বিকল্প তত্ত্ব
কয়েকজন বিজ্ঞানী অতীতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে- তেলের একটি অজৈব উৎস রয়েছে এবং এটি কোনো প্রাণীর অবশিষ্টাংশ ছাড়াই পৃথিবীর গভীরে গঠিত হতে পারে।

এই তত্ত্বের মধ্যে বেশ কয়েকটি ১৯ শতকের প্রথম দিকে প্রস্তাব করা হয়েছিল, উদাহরণস্বরূপ; রাশিয়ান রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্দেলিভ এসব উপাদানের প্রথম পর্যায়ের সারণী প্রকাশ করেছিলেন।

অজৈব তত্ত্বগুলো মনে করে যে- পৃথিবীর ওপরের দিকের স্তরে, কার্বন মূলত হাইড্রোকার্বন অণু বিশেষ করে, মিথেন হিসাবে বিদ্যমান থাকতে পারে।

পেট্রোলিয়ামে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোকার্বন পাওয়া গেছে যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে উৎপন্ন হয়। এজন্য জৈব জীবাশ্মের প্রয়োজন হয় না।

এই হাইড্রোকার্বনগুলো পৃথিবীর ভেতরের অংশ থেকে ভূত্বকের দিকে স্থানান্তরিত হতে পারে। এটি ভূপৃষ্ঠের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে বা ওপরের দিকের অভেদ্য স্তরে তেল জমাতে পারে।

এই তত্ত্বগুলোর একটি সংস্করণের কথা বলেছেন অস্ট্রিয়ান জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী টমাস গোল্ড (১৯২০-২০০৪), যিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন।

গোল্ড ১৯৯২ সালে আমেরিকান একাডেমী অফ সায়েন্সের জার্নাল পিএনএএস-এ ‘ডিপ হট বায়োস্ফিয়ার’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন, পরে একই শিরোনামে তিনি একটি গ্রন্থ লেখেন।

গোল্ডের মতে, পৃথিবীতে হাইড্রোকার্বন জৈবিক বর্জ্য বা জীবাশ্ম জ্বালানির কোনো উপজাত নয়। তবে, এটি এমন এক উপাদান যা প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর গঠন হওয়ার সময় থেকেই ছিল।

গোল্ড স্বীকার করেছেন যে- একই ধারণা ১৯৫০ -এর দশকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরাও দিয়েছিলেন।

পেট্রোলিয়ামের অজৈব উৎপত্তির তত্ত্বটি বেশিরভাগ বিজ্ঞানী গ্রহণ করেননি।

‘আমরা আমাদের একাডেমিক এবং বৈজ্ঞানিক সহকর্মীদের হয়ে সাহস করে বলেছি যে- অজৈব উৎসের তত্ত্বগুলো সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়নি এবং পরীক্ষাগারে এই উপায়ে হাইড্রোকার্বন তৈরি করা সম্ভব হয়নি,’ ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকোর বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন।

শেষ প্রশ্ন
যেহেতু পেট্রোলিয়ামের উৎপত্তির জৈব তত্ত্বটি সর্বাধিক গৃহীত, সম্ভবত কিছু পাঠক নিজেদের এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

যদি মেসোজোয়িক যুগে তেল তৈরির সময়ে ডাইনোসররাও পৃথিবীতে বিচরণ করতো, তাহলে এমনটাও হতে পারত যে- তাদের দেহাবশেষ এবং ডাইনোসরের জৈব পদার্থ, সমুদ্র বা হ্রদের তলদেশে পতিত হতো-। বহু সময় ধরে সংকোচন এবং রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তেলে রূপ নিতো।

‘এক কথায় বলা যায় যেকোনো জৈব পদার্থ থেকে তেল উৎপাদন হতে পারে,’ ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকোর বিশেষজ্ঞরা তাই বলেছেন।

‘তবে, এটি উল্লেখ করা জরুরি যে- তেল উৎপাদন একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া এবং বিপুল পরিমাণ পদার্থের প্রয়োজন হয়, যা শুধুমাত্র সমুদ্রে প্ল্যাঙ্কটনের বিশাল পরিমাণের কারণে অর্জন করা সম্ভব, কিন্তু অন্যান্য পদার্থ এতো পরিমাণে নেই,’ তারা পরিশেষে বলেন।
সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস