দিল্লিতে জি-২০-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা, গলার কাঁটা সেই ইউক্রেন

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

বুধবার সন্ধ্যায় দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ২০টি অর্থনীতির জোট জি-টোয়েন্টির সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিশেষ নৈশভোজে আপ্যায়ন করছে ভারত, যার পোশাকি নামকরণ করা হয়েছে ‘নেটওয়ার্কিং রিসেপশন’।

জি-টোয়েন্টির বর্তমান চেয়ার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এস জয়শঙ্করই এই নৈশভোজের হোস্ট, তবে সেখানে ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কোনো প্রবেশাধিকার থাকছে না।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনি ব্লিঙ্কেন, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ, চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং, ব্রিটেনের জেমস ক্লেভারলি থেকে শুরু করে বিশ্ব কূটনীতির প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ মুখকেই দিল্লির এই আসরে দেখা যাবে।

শুধু জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশি দিল্লিতে আসতে পারছেন না, সেই জায়গায় তার ডেপুটি কেনজি ইয়ামাদা জাপানের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

পর দিন (২ মার্চ) রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবন সাংস্কৃতিককেন্দ্রেও এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দিনভর দফায় দফায় নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসবেন। কিন্তু দিনের শেষে কোনো সর্বসম্মত ঘোষণাপত্র আসবে কি না, তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

মাত্র চার দিন আগে ব্যাঙ্গালোরে এই জি-টোয়েন্টিভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের মধ্যকার বৈঠক শেষ হয়েছে। কিন্তু সেখানেও ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে মতবিরোধের জেরে কোনো যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা যায়নি।

ব্যাঙ্গালোরের খসড়া ঘোষণাপত্রে ইউক্রেন সঙ্ঘাতের কথা উল্লেখ করা হলে চীন ও রাশিয়া একযোগে তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সদস্য দেশগুলো শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্নে একমত হতে না পারায় কোনো ঘোষণাপত্রও আসেনি।

ব্যাঙ্গালোর বৈঠকের পর ভারতের পক্ষ থেকে যে ‘চেয়ারম্যান’স সামারি’ (সারাংশ) জারি করা হয়, তাতে শুধু জানানো হয়েছিল বেশির ভাগ সদস্য দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্র নিন্দা জানালেও যে প্যারাগ্রাফগুলোতে ইউক্রেনের উল্লেখ ছিল তাতে রাশিয়া ও চীন স্বাক্ষর করেনি।

দিল্লির লক্ষ্য ভারসাম্য
এদিকে বুধবার দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াটরা জানিয়েছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাত যেভাবে মোড় নিচ্ছে, তাতে জি-টোয়েন্টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচ্য বিষয় হবে।’

ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা হলেও জোট হিসেবে জি-টোয়েন্টি শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছবে বা যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করতে সফল হবে, আয়োজক তথা চেয়ার ভারতও এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারছে না।

জোটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চীন ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, জি-টোয়েন্টির আলোচনায় ইউক্রেন প্রসঙ্গ ছায়া না ফেললেই ভালো।

চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফরের আগে তার মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গতকাল (মঙ্গলবার) বলেছেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি ও উন্নয়নের সামনে আজকে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, দিল্লিতে ওই মূল বিষয়ের ওপরই আলোচনার ফোকাস থাকবে বলে আমরা আশা করছি।’

বহুপাক্ষিকতা (মাল্টি-ল্যাটারালিজম), খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন সহযোগিতার প্রশ্নে জি-টোয়েন্টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক যেন ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে, চীন সেজন্য সবার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত বলে জানানো হলেও ইউক্রেনের কথা তারা একবারো উল্লেখ করেনি।

রাশিয়া ও চীনের এ ধরনের অনড় মনোভাবের পটভূমিতে আপাতত ভারতের লক্ষ্য হবে গত বছরের নভেম্বরে বালি-তে জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনের ধাঁচে একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে উপনীত হওয়া।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, ‘বালির সামিটে যেভাবে জি-টোয়েন্টির শীর্ষ নেতারা একটা ঘোষণাপত্রে পৌঁছতে পেরেছিলেন, দিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকেও ওই রকম একটা অবস্থানে পৌঁছনোর জন্য আমরা চেষ্টা চালাব।’

ভারত মনে করিয়ে দিচ্ছে, মাত্র তিন মাস আগে নভেম্বরেই জি-টোয়েন্টি একটি ‘সুচিন্তিত ও ভারসাম্যপূর্ণ’ অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছিল এবং সব সদস্য দেশই তাতে সায় দিয়েছিল। ফলে দিল্লিতেও একই লক্ষ্য অর্জন করা একেবারে অসম্ভব নয় বলেই দিল্লিতে সাউথ ব্লকের কর্মকর্তাদের বিশ্বাস।

মস্কোকে সমর্থনেই জটিলতা?
তবে ভারতের অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, গত এক বছর ধরে চলে আসা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পরিস্থিতিকে এখানে আরো জটিল করে তুলেছে।

ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটিতে ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। বরং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারত রাশিয়া থেকে তুলনামূলকভাবে সস্তায় তেল কেনা শুরু করেছে এবং এর পরিমাণও ক্রমশ বেড়েছে।

এই পটভূমিতেই ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র কংগ্রেস নেতা শশী থারুর এক সাক্ষাতকারে মন্তব্য করেছেন, রাশিয়াকে তুষ্ট করতে গিয়ে ভারত জি-টোয়েন্টিতে নিজের নেতৃত্বকেই দুর্বল করে ফেলেছে।

তিনি বলেছেন, ‘এমনকি ঘোষণাপত্রে ‘যুদ্ধ’ শব্দটা ব্যবহার না করার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিতেও রাশিয়া দ্বিধা করছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘এটা আসলে চেয়ার দেশেরই ব্যর্থতা। আমি তো বলব, এখানে ইন্ডিয়ার নার্ভ ফেইল করেছে, যে বিবৃতি একটি দেশকে অসন্তুষ্ট করবে, তার জায়গায় কোনো সর্বসম্মত বিবৃতি দিতে না পারাটা চেয়ারম্যানের জন্য অনেক বড় ব্যর্থতা।’

তবে কোনো কোনো কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক আবার এক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করছেন।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তথা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন যেমন বিশ্বাস করেন, ব্যাঙ্গালোরে জি-টোয়েন্টি অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক একটা ‘দৃষ্টান্ত’ তৈরি করে দিয়েছে আর এতে হয়তো শেষে ভারতেরই সুবিধা হবে।

সোমবার দিল্লিতে ফরেন অ্যাফেয়ার্স কভার করা সাংবাদিকদের সাথে এক বৈঠকে মেনন বলেন, ‘চীন ও রাশিয়া একসাথে মিলে জি-টোয়েন্টির বৈঠকগুলো উতরে দেয়ার একটা প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ প্যাটার্ন অনুযায়ী তারা জোটের বক্তব্যের কিছু কিছু অংশে আপত্তি জানাবে। অন্যদিকে বাকিরা ইউক্রেন নিয়ে তাদের যা বলার বলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো যৌথ বিবৃতি আসবে না। এতে হয়তো ভারতেরও সুবিধা হবে।

গত বছরের জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়াতে জি-টোয়েন্টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের অনুরূপ একটি বৈঠক কার্যত ভেস্তে গিয়েছিল। কারণ পশ্চিমা অনেক দেশই সেখানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের উপস্থিতি মেনে নিতে পারেননি।

দিল্লির বৈঠকে লাভরভ নিজে থাকছেন, যোগ দিচ্ছেন আমেরিকা-যুক্তরাজ্য-ইইউ-ইটালি বা জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও।

যৌথ বিবৃতি শেষ পর্যন্ত সম্ভব হোক বা না হোক, বর্তমান ভূরাজনৈতিক আবহে এটাকেও একটা বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে জি-টোয়েন্টির বর্তমান চেয়ার ভারত।

সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস