নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায় সোমবার

সর্বোচ্চ শাস্তির আশায় নিহতদের পরিবার

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ
অপেক্ষার প্রহর শেষে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের মামলার রায় সোমবার (১৬ জানুয়ারি)  ঘোষণা করা হচ্ছে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন রায় ঘোষণা করবেন। এ রায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন সাত খুনে নিহতদের পরিবার। তাদের আশা রায়ে আদালত আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি প্রদান করবেন। এ রায় কেন্দ্র করে আদালত পাড়ায় নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। সাত খুনের রায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসীসহ, সারাদেশ। এই হত্যাকান্ডগুলো নারায়ণগঞ্জবাসীকে কলংকিত করলেও মুলত এ হত্যাকন্ডগুলো ঘটিয়েছে জেলার বহির্ভূত লোকজন। এদিকে সাত খুনের রায়কে ঘিরে স্বজনহারা পরিবারগুলো আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। রায়কে ঘিরে যেন কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখিন তাদের হতে না হয়, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন নারায়ণগঞ্জবাসী।

এ মামলায় আ’লীগ নেতা নূর হোসেন, চাকরিচ্যুত র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক ও মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, উপ-অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এমএম রানাসহ ২৩ আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। চার্জশিটভুক্ত ৩৫ আসামির মধ্যে ১২জন পলাতক। গ্রেফতার ২৩ আসামির মধ্যে আ’লীগ নেতা নূর হোসেনের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা হলো, নূর হোসেনের প্রধান বডিগার্ড মর্তুজা জামান চার্চিল, প্রধান ক্যাশিয়ার আলী মোহাম্মদ, ক্যাশিয়ার সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আ’লীগের সহ প্রচার সম্পাদক আবুল বাশার, মাদক স্পট, জুয়া ও অশ্লীল নৃত্য পরিচালনাকারী রহম আলী ও মিজানুর রহমান।

বাদি পক্ষের আইনজীবি অ্যাডভোকেট. সাখাওয়াত হোসেন খানের প্রত্যাশা সাত খুনের মামলার সুষ্ঠু বিচার হবে। সাক্ষ্য প্রমাণে আসামিদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হবে। আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা রয়েছে। সেই আস্থা থেকেই আমার বিশ্বাস আসামীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিবেন আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, যুক্তিতর্ক ও আসামিদের জেরাতে রাষ্ট্রপক্ষ তথা আমরা আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, মামলায় অভিযুক্তরা সবাই সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা, গুমসহ পুরো কার্যক্রমে জড়িত। সেহেতু আমরা আদালতকে সর্বোচ্চ সাজা দিতেও দাবি জানিয়েছি। আশা করছি আদালত আসামিদের মৃত্যুদন্ড দেবেন।

মামলার বাদী নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা ডা. বিজয় কুুমার পাল জানান, দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছি। নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুপুর বেগম মুঠোফোনে বলেন, আমি বিধবা হয়েছি। আমার সন্তান বাবাকে হারিয়েছে। আশাকরি আদালত করে আসামিদের ফাঁসি দিবে। নিহত লিটনের ভাই রফিক মিয়া বলেন, আমরা স্বজন হারিয়েছি। আমরাই এ দুঃখ বুঝি। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি জানাচ্ছি। নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের জানান, আমারা ভুক্তভোগী পরিবার। আমাদের প্রত্যাশা সারাদেশবাসী জানে। তাই আদালতের কাছে প্রার্থনা যাতে এমন একটা রায় দেন যাতে করে আর কোনো বাবাকে তার সস্তান না হারাতে হয়। আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দাবি জানাচ্ছি।

দুটি মামলার তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকুরীচ্যুত সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। এতে দুটি মামলাতে সাক্ষী করা হয়েছে ১২৭ জন করে। মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন ২৩ জন। আর পলাতক আছেন ১২ জন। তবে ৩৫ আসামির পক্ষেই চলে মামলার কার্যক্রম। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে মাত্র আট মাসেই ৩০ নভেম্বর মামলার আইনি কার্যক্রম শেষ হয়। ১২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে আদালত।
সাত খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হলেও চার্জশিটভুক্ত না হওয়ায় নূর হোসেনের যে ১০ সহযোগী ছাড়া পায়, তারা হলো, বডিগার্ড মহিবুল্লাহ, তানভীর, ইয়াসিন, আলমগীর, গাড়িচালক সোনা মিয়া, জুয়েল আহম্মেদ, মিজান, আবদুর রহিম, আরিফুজ্জামান ও  রফিকুল ইসলাম। এছাড়া এজাহারভুক্ত কিন্তু চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পাওয়া আরও ৫ জন হলো- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াসিন মিয়া, নাসিক কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন, ঠিকাদার হাসমত আলী হাসু, থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু ও আনোয়ার।

আ’লীগ নেতা নূর হোসেনের সহযোগীরা এখনও সক্রিয় ! : নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন কারাগারে থাকলেও তার সহযোগীরা এখনও সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে তার কয়েকজন সহযোগী এবার নির্বাচিতও হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সহযোগীদের কেউ কেউ দাপটের সঙ্গে এলাকায় অবস্থান এবং চাঁদাবাজিসহ অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

সাত খুনের আগে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ট্রাক স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজিসহ, মাদক ব্যবসা, জুয়া ও  অশ্লীল নৃত্য পরিচালনা করতো নূর হোসেন। এই অবৈধ উপার্জন থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থাকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হতো। সাত খুন মামলার আসামিদের জবানবন্দি ও চার্জশিটে উঠে এসেছে এসব তথ্য। নূর হোসেনের যেসব অনুসারী এই সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো, তারা পুনরায় নিজ নিজ এলাকায় শক্ত অবস্থান গড়ে তুলছে ।

কাউন্সিলর ও জেলা পরিষদের মেম্বার পদে নূর হোসেনের সহযোগীরা : নূর হোসেনের শ্যালক নূরে আলম খান পুলিশের খাতায় সন্ত্রাসী। গত বছর রাজধানীর মহাখালীতে নূর হোসেনের (লাইসেন্স বাতিলকৃত) পিস্তলসহ ধরা পড়ার পরও চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে পালিয়ে যায়। গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে সে ৯ নম্বর ওয়ার্ড  (জামপুর ইউনিয়ন, নোয়াগাঁও ইউনিয়ন, কাঁচপুর ইউনিয়ন ও সাদিপুর ইউনিয়ন) থেকে  ৪০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। নাসিক নির্বাচনে দুই নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছিলেন নিহত সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি সাত খুন মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া আসামি ইকবাল হোসেনের কাছে হেরেছেন। ২০১৪ সালে নজরুলের মৃত্যুর পর উপ নির্বাচনে কাউন্সিলর হয়েছিলেন বিউটি। ওই সময় নূর হোসেনের অনেক সহযোগী ছিল পলাতক। তবে এবার তারা এলাকায় বীরদর্পে  কাজ করেছে ইকবালের পক্ষে এবং বিউটির বিরুদ্ধে। সাত খুন মামলার এজাহারে ইকবাল ছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিনকে আসামি করেছিলেন বিউটি। তিন নম্বর ওয়ার্ডে এবারও জিতেছে নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল। সাত খুনের পর সে দীর্ঘদিন পলাতক ছিল। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এলাকায় ফিরে এলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে সে জামিনে মুক্তি পায়। চার নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নূর হোসেনের আর্শিবাদপুষ্ট আরিফুল হক হাসান জিতেছে। গত বছরের ২৮ এপ্রিল মদসহ আরিফুলকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছিল। ছয় নম্বর ওয়ার্ডে থানা যুবলীগের আহ্বায়ক  মতিউর রহমান জিতেছে। সাত খুনের পর সেও অনেক দিন পলাতক ছিল।  নূর হোসেনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সাত খুনের ঘটনায় নজরুলের সঙ্গে নিহত স্বপনের ভাই মিজানুর রহমান খান রিপন সাত নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচন করে হেরেছেন। এখানে জিতেছে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ আলী হোসেন আলা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নূর হোসেনের ভাই নুরুজ্জামান জজ এলাকায় ফিরেই কাঁচপুর সেতুর ঢালে ‘মেসার্স জেরিন ট্রেডার্স’ নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বালুর ব্যবসা শুরু করেছে। শিমরাইল ট্রাক টার্মিনালটির নিয়ন্ত্রণ ছিল মনিরের ভাই ছোট নজরুলের হাতে। কাউন্সিলর আরিফুল ও কাউন্সিলর বাদল এখন ট্রাক স্ট্যান্ডটি নিয়ন্ত্রণ করছে। নূর হোসেনের ভাতিজা আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু এলাকায় ফিরে লেগুনা ও টেম্পুস্ট্যান্ড দখলে নিয়েছে। সেখানে ৩০০ লেগুনা থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।
সাত খুন মামলার বাদী ও নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি অভিযোগ করেন, মামলার কারনে এবার আ’লীগ নেতা হাজী ইয়াছিন তার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। সে কারণেই নির্বাচনে তিনি হেরে গেছেন। বিউটি বলেন, এখন আমাদের উল্টো হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি সরাফত উল্লাহ জানান, কেউ কাউকে হুমকি দিচ্ছে, কিংবা স্বাভাবিক কর্মকান্ড বাধা দেওয়া হচ্ছে এমন কোনও অভিযোগ কেউ করেনি। করলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।