প্রশ্নবিদ্ধ কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা, বাড়তি চাপে স্বাস্থ্য ঝুকিতে শিশুরা

গৌরিপুর প্রতিনিধিঃ    সঠিক শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতি ছাড়াও প্রশিক্ষিত শিক্ষক বিহীন চড়ামূল্যে শিক্ষার্থী ভর্তি এবং শিক্ষার চেয়ে বাণিজ্যিক বিষয়টি অধিকতর বিবেচনায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বইয়ের বোঝা চাপানো ইত্যাদি নানাবিদ সংকটেও দৌরাত্ব থেমে নেই আমাদের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর। এধরনের স্কুলগুলো একদিকে যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমাজের বিত্তবান মানুষের একটা দূরত্ব সৃষ্টি করছে তেমনি বিদ্যমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি সমাজের বিশেষ একটা শ্রেণী মনোযোগ হারাচ্ছে। ফলে বাধ্যতামূলক সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার মানও আশানুরূপ হচ্ছে না।

কিন্ডারগার্টেন শিশুদের প্রাক-বিদ্যালয় বা বিদ্যালয়-পূর্ব উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ। এ শব্দটি জার্মান, যার অর্থ হচ্ছে শিশুদের বাগান। ‘কিন্ডারগার্টেন’ শব্দটি বিখ্যাত জার্মান শিশু-শিক্ষানুরাগী ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবল কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। তিনি ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে কিন্ডারগর্টেন নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তার মতে, শিশুরা বাগানের চারা ও ফুলের তুল্য। তাই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যতœআত্তিও হওয়া দরকার- পরম আদর, সোহাগ ও নান্দনিকতার স্পর্শে। আর সেই নান্দনিকতার পরশেই শেখার আগ্রহে শিশু যুক্ত হবে শিক্ষাজীবনে। কারণ শিক্ষা ছাড়া শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটে না। আর এ ধরনের স্কুলগুলোর আসল উদ্দেশ্য হলো নানারকর্মের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে শিশুর সার্বিক উন্নতিসাধন তথা মুক্ত পরিবেশে সাবলীল অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানো। কিন্তু আমাদের দেশে কোমলমতি শিশুশিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিন্ডারগার্টেনগুলো শিশুশিক্ষার জন্য উপযোগী কিনা তা কিন্ডারগার্টেনের কার্যক্রম ও শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াগুলোতে কার্যত কোনো পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন পরিলক্ষিত হয় না। জানা যায়, এসব বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধা, শিক্ষার্থী ভর্তি, ভর্তি ফি নির্ধারণ, প্রযুক্তিগত ব্যবহার এবং পাঠ্যবই অর্ন্তভূক্তির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না।

উপজেলা শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কেবলমাত্র ডি,আর ভুক্ত কিন্ডার গার্টেন গুলো প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আওতাধীন পঞ্চম শ্রেণীর প্রাক-সমাপনি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করলেও এই সমস্ত স্কুলের তদারকিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তা না থাকায় এর সঠিক শিক্ষা কার্য্যক্রম ও পদ্ধতি মানা হচ্ছে কিনা তার দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে তার পর্যাপ্ত তথ্যাবলীও নেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কাছে।
কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পাঠ্যবই ব্যবহার করলেও তাদের নিজস্ব পরিচালানায় পাঠ্যক্রমে বাড়তি বইয়ের ব্যবহার বিদ্যমান আছে জানিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, ভালো মানের শিক্ষা ব্যবস্থা সকলেরই কাম্য। তবে, আমাদের শিক্ষানীতির ঘোষণা মতে, শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করার আগে শিশুর অর্ন্তনিহিত অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতূহল, আনন্দবোধ ও অফুরন্ত উদ্যমের মতো সর্বজনীন মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশ এবং প্রয়োজনীয় মানসিক দৈহিক প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি অনুসারে শিশুদের স্বাধীনতা দেয়া হয় নিজেকে প্রকাশ করার। কিন্তু শিশু চাপ বোধ করে এমন কিছু চাপিয়ে দেয়ার বিধান নেই।

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলই আংশিক, কিঞ্চিৎ কিংবা নামমাত্র কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি অনুসরণ করে। অধিকাংশ স্কুলই সঠিক শিক্ষার্থী ভর্তির কৌশল হিসেবে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার জন্য ‘কিন্ডারগার্টেন স্কুল’ নামটি ব্যবহার করে থাকেন। এসব স্কুলে প্লে-গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হলেও মূলত বংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন হলো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে প্রশিক্ষিত শিক্ষার হার খুবই নগণ্য। গণসাক্ষরতা অভিযানের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে কিন্ডারগার্টেনগুলোর শিক্ষকদের মাত্র ১৫ শতাংশ ছিলেন প্রশিক্ষিত। যেখানে একই সময়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার ছিল ৯৪ শতাংশ।

জানা যায়, ২০১২ সালের সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে অবশ্যই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যবই পড়াতে হবে। এর বাইরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তালিকাভুক্ত যুগোপযোগী অন্যান্য বই পাঠ্যক্রমে অর্ন্তভূক্ত করা গেলেও অভিযোগ রয়েছে, এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চড়ামূল্যে শিশুশিক্ষার্থী ভর্তি ছাড়াও শিক্ষার চেয়ে বাণিজ্যিক বিষয়টি অধিকতর বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের একাধিক অভিভাবক জানান, ২০১৮ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণী‘র পাঠ্যসূচীতে বাংলা, ইংরেজী, অংক সহ মোট ৬টি বই নির্ধারিত থাকলেও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর একই শ্রেণীতে বাংলা, ইংরেজী, অংক, ছাড়াও বাংলা ২য়, ইংরেজী ২য়, জ্যামিতি, সাঃ জ্ঞান ও  অংকন সহ প্রায় ১১টি বই পাঠ্যসূচীতে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও এর প্রতিটি পাঠ্য পুস্তকের বিপরীতে এইস,টি খাতা বাধ্যতামূলক। ফলে ওই শিক্ষার্থীকে বাড়তি বইয়ের বোঝা বহন করা ছাড়াও অভিভাবককে গুনতে হচ্ছে বাড়তি বইয়ের চড়ামূল্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইত্যাদি নানাবিদ চাপ ছাড়াও সম্প্রতি এসকল স্কুল সমূহের বাধ্যতামূলক কোচিং ব্যবস্থাপনার চাপে চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে কিন্ডার গার্টেন স্কুল ছেড়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন অনেকই।
বাড়তি বইয়ের বোঝা ও বাড়তি পড়ার চাপ শিশুর জীবনে কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে জানাতে চাইলে, মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ ফিরোজ খান এ প্রতিবেদককে জানান, শিশু‘র বয়স ও তার শারীরিক গঠন আকৃতি বিবেচনা ব্যতিরীকে তাদের উপর পড়ালেখার চাপ বৃদ্ধি করা বা বাড়তি বইয়ের বোঝা চাপানো শিশুকে মানসিক ও শারীরিকভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকিতে ফেলতে পারে।

প্রসঙ্গত, শিশু তার শারীরিক ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন করলে শিশুদের শরীরিক ইনজুরি হয়। ফলে এবিষয়টি বিবেচনায় রেখে যে কোন প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুদের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন নিষিদ্ধের বিষয়ে ইতিমধ্যেই আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর পরও থেমে নেই কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত বই অর্ন্তভূক্তিকরন প্রক্রিয়া।

শিক্ষা অনুরাগীদের মতে, শিশু শিক্ষার অতি মূল্যায়ন শিশুর জীবনকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলে, তেমনি স্বীকৃত শিশুশিক্ষা পদ্ধতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ উভয় সংকট থেকে বাঁচতে এবং শিক্ষার প্রতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টিমূলক ও সুকুমারবৃত্তির অনুশীলন স্বতঃস্ফূর্ত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন খুবই জরুরী।