বিটিসিএল : বিনিয়োগ আছে,সেবার মানে উন্নতি নেই

ডেস্ক রিপোর্ট : বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বিভিন্ন প্রকল্পে গত কয়েক বছরে বিনিয়োগ হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বড় ধরনের এ বিনিয়োগের পরও উন্নতি নেই সেবার মানে। সারা দেশে বিটিসিএলের অর্ধেকের বেশি টেলিফোন সংযোগই বিকল হয়ে আছে। এতে কমছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রতি গ্রাহক আস্থা। বিনিয়োগের প্রভাব নেই প্রতিষ্ঠানটির আয়েও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খারাপ অবস্থায় রয়েছে রাজধানীর ৫০ শতাংশ টেলিফোন সংযোগ। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরো নাজুক। বিভাগীয় শহরগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ সংযোগ বিভিন্ন সময় অকার্যকর থাকে। আর জেলা শহরগুলোয় এ হার ৭৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে সারা দেশে বিটিসিএলের সাত লাখের মতো সংযোগের অর্ধেকই কোনো না কোনোভাবে অকার্যকর।

গ্রাহকদের অভিযোগ, মাসের পর মাস লাইন খারাপ থাকলেও প্রতি মাসে ভাড়া গুনতে হয় ঠিকই। অভিযোগ করলেও লাইন সচলের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। সময়মতো পৌঁছে না বিলের কাগজও। যদিও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে প্রতি মাসের ৮ তারিখের মধ্যে গ্রাহকের কাছে বিল পৌঁছে দেয়ার।

গ্রাহকসেবায় মানোন্নয়নে ব্যর্থ হওয়ায় সংযোগ সক্ষমতাও পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। বিটিসিএলের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১৪ লাখ ৬০ হাজার সংযোগ সক্ষমতার বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৮৫ হাজার সংযোগ।

যদিও গ্রাহক টানতে ল্যান্ডফোনের নতুন সংযোগ মূল্য আগের তুলনায় অর্ধেক করা হয়েছে। ঢাকায় সংযোগ মূল্য ২ হাজার ও ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ১ হাজার টাকা। অন্যান্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরে বিটিসিএলের ল্যান্ডফোনের সংযোগমূল্য ৬০০ টাকা। কল রেটও আগের তুলনায় কমানো হয়েছে। লোকাল কলের ক্ষেত্রে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতি মিনিট ৩০ পয়সা ও রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিটিসিএল থেকে অন্যান্য অপারেটরে কলের ক্ষেত্রে প্রতি মিনিট ৮০ পয়সা। কমানো হয়েছে মাসিক লাইন রেন্টও। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় প্রতি মাসে লাইন রেন্ট ১৬০ টাকা। অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরে মাসিক লাইন রেন্ট ১২০ টাকা আর উপজেলা ও গ্রোথ সেন্টারের গ্রাহকদের জন্য তা ৮০ টাকা। এসব সুযোগের পরও গ্রাহকদের আগ্রহ বাড়াতে পারেনি বিটিসিএল। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বিটিসিএলের নতুন সংযোগ গ্রহণ ও সংযোগ-পরবর্তী সেবাদানে প্রতিষ্ঠানটির অপেশাদারি মনোভাবের কারণেই গ্রাহক আস্থা বাড়ছে না।

গ্রাহকসেবার পাশাপাশি বিটিসিএলের রাজস্ব আয় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আগে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয় হতো ৪৫-৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে তা ২১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। রাজস্ব আয়ের বড় অংশই আসছে লাইন ভাড়া থেকে। প্রতি মাসে প্রায় ১১ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয় শুধু লাইন ভাড়া থেকে। বাকিটা কল চার্জ থেকে।

পরিকল্পিত বিনিয়োগ না হওয়াকেই এর কারণ বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে বিটিসিএলের বিনিয়োগ বেশি হয়েছে ডাটা খাতে। অথচ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (শুক্র ও শনিবার) বন্ধ থাকায় বিটিসিএলের ডাটা ব্যবহারে কেউ আগ্রহ দেখান না। এছাড়া বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার প্রকল্পগুলো গ্রামভিত্তিক হওয়ায় সেভাবে ফলাফল আসছে না। এর বাইরে অনিয়ম-দুর্নীতি তো রয়েছেই।

কাক্সিক্ষত আয় না থাকলেও পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্পদ সংগ্রহ খাতে বিটিসিএলের ব্যয় হয় প্রতি মাসে ৩৫ কোটি টাকা। এ ব্যয় মেটানো হয় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সঞ্চিতি থেকে। যদিও বড় অংকের অর্থ বকেয়া আছে প্রতিষ্ঠানটির, যা আদায়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিটিসিএলের স্থানীয় রাজস্ব বকেয়া প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। বৈদেশিক ক্যারিয়ারের কাছে পাওনা আরো ১ হাজার কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই টেলিযোগাযোগ খাতের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কলের বাজার দখলে ছিল প্রতিষ্ঠানটির। আয়েও ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা ছিল। পরবর্তীতে বেসরকারি খাতে সেলফোন অপারেটর ও ফিক্সড ফোনসেবা চালু হওয়ায় এ বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায় বিটিসিএলের।

২০০৮ সালে বিটিসিএলসহ চারটি প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানে আইজিডব্লিউর লাইসেন্স দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক কল নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়ায় হোঁচট খায় বিটিসিএলের আয়ও। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় সে বছর আয়ও কমে যায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। পরে ২০১২ সালে আরো ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয়া হয়। ফলে আন্তর্জাতিক কলের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে বিটিসিএলের আয়ে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮৪৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিটিসিএলের আয় হয় ৮২১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। আর বিটিসিএল প্রকাশিত সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭৮৪ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আয় করতে পারে ৩৭৫ কোটি টাকা।

বিটিসিএলের আয় ও গ্রাহকসেবায় প্রভাব না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব, সরকারি ও বিদেশী অর্থায়নে বড় অংকের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এসব প্রকল্পে নানা দুর্নীতির অভিযোগও আছে। বিটিসিএল কর্মকর্তাদের সহায়তায় ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকলের (ভিওআইপি) মাধ্যমে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পাঁচ এমডিসহ মোট ২২ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের দায়েরকৃত মামলায় বলা হয়েছে, একটি চক্র বিটিসিএল কর্মকর্তাদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশে আন্তর্জাতিক কল ডাটা মুছে ফেলে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই বিটিসিএলে বড় ধরনের বিনিয়োগ হলেও তাতে কাক্সিক্ষত ফল মেলেনি। গত আট বছরে ১৩ বার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে পরিবর্তন হয়েছে বিটিসিএলে। সর্বশেষ এমডি করা হয় মাহফুজ উদ্দীন আহমেদকে।

শ্রীলংকাভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, বিটিসিএলে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না আসার সবচেয়ে বড় কারণ নেতৃত্বের দুর্বলতা। এত ঘন ঘন এমডি পদে পরিবর্তন হয়েছে যে, সংস্থাটিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সেই অর্থে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, আবার এ রকম একটি উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষেত্রে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় প্রত্যাশিত সাফল্য মিলছে না। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিটিসিএলের এমডি মাহফুজ উদ্দীন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না।