মানবিক হতে বিচারক-আইনজীবীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

বিডিসংবাদ ডেস্কঃ বিচার বিভাগের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই আন্তরিক।

শেখ হাসিনা বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সংবিধানে সুবিচার ও সাম্যের বাণীকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজে ভুক্তভোগী ছিলেন বলেই সকলের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে মানবাধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেন।

সবকার প্রধান বলেন, বিনাদোষে এবং বিনাবিচারে বঙ্গবন্ধুকে বছরের পর বছর জেলখানার নির্জন সেলে একাকী বন্দী করে রাখা হয়েছিল। বিচারের নামে প্রহসনও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লে আমরা জানতে পারি কী দুঃসহ দুঃখকষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর বিচার কাজ চলতো।

এ সময় শেখ হাসিনা আমাদের সংবিধান থেকে উদ্বৃত করে বলেন, আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং সকলেই আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী’। আবার ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে’।

তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের আইনগত সহায়তা লাভের অধিকার রয়েছে। আমরা একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আধুনিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম এ বৈষম্য দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বলে আমি মনে করি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সকল জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ জনগণ সরকারি অর্থ ব্যয়ে আইনগত সহায়তা পাচ্ছেন। এছাড়া, এসিডদগ্ধ নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, প্রতিবন্ধী, পাচারকৃত নারী বা শিশু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠীর জনগণও এই আইনগত সহায়তা পেয়ে থাকেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত আদালতগুলোতে এবং শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম আদালতসমূহে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া, ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনগত সহায়তা কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টেও সরকারি আইনি সেবা দেয়া হচ্ছে।

সরকার প্রধান বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৮ বছরে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৩৯ জন নারী-পুরুষ শিশুসহ মোট ২ লক্ষ ৩১ হাজার ৬ শত ২৬ জন ব্যক্তিকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমের মোট ৪৬ হাজার ৫৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে বিগত ৮ বছরে সুপ্রীম কোর্টে মোট ১ হাজার ৬ শত ৯৩টি আপীল মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

তার সরকার প্রত্যেক জেলায় প্রয়োজনীয় জনবলসহ একটি করে স্থায়ী ‘লিগ্যাল এইড অফিস’ স্থাপন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সকল অফিস পরিচালনার জন্য ৬৪টি ‘জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার’ এর পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিজ্ঞ বিচারকগণকে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে শুধু আইনি সহায়তার কেন্দ্র হিসেবে আমরা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। বিচারপ্রার্থী জনগণের কল্যাণে এটিকে আমরা ‘এডিআর কর্ণার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে কাজে লাগাতে চাই। আপোষ-মীমাংসা বা সমঝোতার মাধ্যমে স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তিতে লিগ্যাল এইড অফিস কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

তিনি বলেন,‘জুলাই ২০১৫ সাল হতে এ পর্যন্ত জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে মোট ৩ হাজার ৫০০টি বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৭৫ হাজার ৬ শ’ টাকা আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে দেয়া হয়েছে’।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর পরই জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (এমেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট,২০০৯ পাশের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কাজটিকে স্থায়ী রূপ করি।

তিনি বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও মামলা জট বিচার বিভাগের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় অধঃস্তন আদালতে দীর্ঘদিন বিচারক নিয়োগ বন্ধ থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অধঃস্তন আদালতে ৫৮৬ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৩শ’ ৫০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং নতুন নতুন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।

মামলাজট নিরসন ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা দূর করতে তার সরকার আইনি সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদালতে বিচারাধীন মামলাসমূহ বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি দেওয়ানী কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধনের কাজ চলছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি সেক্টরে একজন জেলা জজসহ সাত সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং জ্বালানি সেক্টরের সকল বিরোধ প্রচলিত আদালতের পরিবর্তে এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, তার সরকার বিচার বিভাগে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার চালু করেছে। এতে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে ৫শ’ ৪০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অধঃস্তন আদালতের দেড় হাজার বিচারকের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সম্প্রতি ভারতের ন্যাশনাল জুডিসিয়াল একাডেমির সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া, দাগী আসামীদের আদালতে আনা-নেয়ার পৃথক যানবাহন থাকবে এবং কারাগার থেকেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করারও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।