যে কারনে ঝিনাইদহের গর্ব আমেনা খাতুন

ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ আমেনা খাতুন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সাত মাস বয়সে পিতাকে হারিয়েছিলেন। তিনটি সন্তান নিয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিধবা হন তার মা রহিমা খাতুন। জীবনযুদ্ধ সেখান থেকেই। সে যুদ্ধে হেরে যাননি আমেনার মা। হেরে যাননি আমেনা। স্বচ্ছল একটি পরিবারে শুধু রাজনৈতিক কারণে শোকের ছায়া নেমে আসতে পারে তার উদাহরণ আমেনার পরিবার।

পরিবারে কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। শুধু অভাব ছিল একজন অভিভাবকের। আমেনার বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। মহেশরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই সঙ্গে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের দীর্ঘ দিনের চেয়ারম্যান। তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। বিএনপি সন্ত্রাসীরা বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করে আমেনার পিতা লুৎফর রহমান মল্লিককে।

আসুন আমেনার মুখে শুনি তাদের সেই সময়ের গল্প। একই সঙ্গে তার সুদিনেরও গল্প শুনবো আমরা। আমেনার বয়স তখন মাত্র ৭ মাস। বড় বোন রোজিনা খাতুন আর ভাই মাসুদুর রহমান মল্লিক এর বয়স দশ বছর। বলতে শুরু করলেন আমেনা-

আমার বয়স সাত মাস। বড় ভাই এর বয়স ১০ বছর। বোনের সাত বছর। পরিবারের একমাত্র অভিভাবক আমার পিতা। তিনি তখন মহেশপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সেটা ১৯৮০ সালের কথা। আব্বা ঢাকায় গিযয়েছিলেন দলীয় একটি মিটিং-এ যোগ দিতে। মিটিং শেষে বাড়িতে ফিরছিলেন। বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসের কাছে ভৈরবী বাজার। সেখানেই বিএনপি সন্ত্রাসীরা বোমা হামলা চালায়। ঘটনাস্থলেই আব্বা নিহত হন।

আমরা তিনটি ছোট ছোট ভাই বোন। এদের নিয়ে মা একা হয়ে যান। তখনও আমার দাদা রহমত মল্লিক বেঁচে ছিলেন। তিনিই আমাদের আগলে রাখলেন। এবার দাদার অভিভাবকত্বে আমরা বেড়ে উঠতে লাগলাম। কিন্তু দাদা বেশি দিন বেঁচে থাকেননি। আমার চার বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তখন আমার নানা-নানীরা আমার মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা যাননি। তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি স্বামীর সংসার আগলে রাখলেন। অভিভাবক হিসেবে মামাকে নিয়ে এলেন আমাদের বাড়িতে। মামা হাফিজুর রহমানই তখন আমাদের তিন ভাই বোনের অভিভাবক।

আমি ভর্তি হলাম বাঁশবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেটা ১৯৮৭ সালের কথা। কার হাত ধরে প্রাইমারিতে ভর্তি হলেন এ প্রশ্নের উত্তরে আমেনা বললেন মনে নেই। তবে বাবা-দাদা যেহেতু কেউ ছিলেন না। তাই মামাই হয়তো আমাকে ভর্তি করিয়েছিলেন। ওই স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি পাস করলাম। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম আলহাজ মফিজউদ্দিন একাডেমিতে। ওই জায়গাটার নাম রুলী। তাই ওই স্কুলটি রুলী হাই স্কুল নামে পরিচিত।

আপনাকে একটু থামাই। আপনার স্কুল জীবন আর লেখাপড়ার গল্প শুনবো। তার আগে বলেন আপনি যখন বুঝতে শিখলেন তখন আপনার বাবার রাজনৈতিক জীবন ও হত্যাকান্ড সম্পর্কেতো গল্প শুনেছেন। সেখান থেকে কিছু বলেন। শুরু করলেন আমেনা। হ্যাঁ আমার বাবা আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। আমাদের রক্তে আওয়ামী লীগ মিশে আছে। বাবা ষাটের দশকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মহেশপুর থানা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। ১৯৭৮ সালে থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৭৯ সালে থানা সভাপতির দায়িত্ব পান। ৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ওই নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৩ আসন থেকে বাবা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু এক ভোটে হেরে যান। এর মাঝে বাবা ১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এখানে বলে রাখি বাবাকে হত্যা করার পর আমার মা ১৯৮০-৮১ সালে থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯১ সালেও ওই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এলাকার মানুষ ‘মা’কে আর বড় ভাইকে চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য বললেও মা রাজি হননি। কারণ বাবাকে যারা হত্যা করেছে তারা আমাদেরও হত্যা করতে পারে। এই ভয় থেকেই ‘মা’রাজনীতি ছেড়ে দেন। তবে আমার ছোট চাচা নওশের আলী মল্লিক এখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি আমাদের মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দুঃখ একটাই তা হলো বাবার হত্যাকারীদের আজো বিচার হয়নি।

এবার আবার স্কুল জীবনের কথায় আসি। বলেন হাই স্কুল জীবন ও কলেজ জীবনের গল্প।

হ্যাঁ হাই স্কুলে পড়ার সময়টাই জীবনের একটা সুখকর সময়। ওই সময় স্কুলে আমার তিনজন বান্ধবী ছিল। ওদের সঙ্গে কত মজা করেছি। খেলাধুলাও করতাম। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। একবার স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করেছিলাম। আর একবার তিনটি ইভেন্ডে নাম দিয়ে তিনটিতেই প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম। এজন্য থানা পর্যায় থেকে পুরস্কার দিয়েছিল।

আপনার সেই সময়ের বান্ধবীদের নাম মনে আছে কী?

হ্যাঁ সবচেয়ে কাছের তিন বান্ধবী হলো হীরা-মুক্তা আর ছবি। এর মধ্যে হীরা এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। মুক্তা আর ছবি গৃহিনী।

লেখা পড়ায় কেমন ছিলেন? লেখাপড়ায় আমি বরাবরই ভালো ছিলাম। আমাকে লেখাপড়ার জন্য তাগাদা দেয়া লাগতো না। আমার-মা-ভাইরা চাইতেন আমি লেখাপড়া করি। কিন্তু লেখাপড়ায় আমার নিজেরই মন বেশি ছিল। নিজে থেকেই সারাক্ষণ পড়তাম। এমনকি কখনো বেশি ঘুমালে মাকে বলতাম তুমি আমাকে ডাকলে না কেন?

হাই স্কুলের সব ক্লাশেই আমার রোল -১/২ এর মধ্যে থাকতো।

রুলী হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করলাম। কলেজে ভর্তি হব। ইতোমধ্যে আমার বড় বোনের বিবাহ হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে। যেহেতু আমাদের বাড়ির কাছে কলেজ ছিল না। তাই বোনের বাড়িতে গেলাম। সেখানে জীবননগর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হলাম।

বোনের বাসায় থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করি। এরপর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্বদ্যিালয়ে বাংলা বিভাগে ও যশোর এমএম কলেজে ইংরেজিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার বড় ভাই বললো, আমাদের দুই ভাই বোনের লেখাপড়া হলো না। তোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবো।

আপনার ভাই বোনদের লেখাপড়া কেন হয়নি?

আমার বড় ভাইও ভালো ছাত্র ছিলেন। তিনি কোর্টচাঁদপুর স্কুল থেকে এসএসসিতে স্টার পেয়েছিলেন। এরপর ঢাকায় পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে ঢাকায় আসার পর বড় বোন অসুস্থ হয়ে পড়ে। বোনের অসুস্থতার খবরে বাড়িতে ফিরে যান। এরপর আর ঢাকায় যাননি।

সেজন্য আমাকে বড় ভাই বললেন, তোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। ভাইয়ের প্রেরণায় আমি ঢাকায় এলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আন্টির বাসায় উঠলাম। সেখানে ২ মাস ছিলাম। ওখানে থেকেই ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম।

জাহাঙ্গীরনগর থেকে যেদিন প্রথম একা একা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছিলাম। সেদিনের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমি বাসে উঠলাম। আন্টি বলেছিলেন কলাভবনে যাওয়ার জন্য। আমি বাসের হেলপারকে বললাম কলাভবনে যাব। সে আমাকে কলাবাগান নামিয়ে দেয়। কলাবাগান নামিয়ে দেয়ার পর একটু ভয় পেলাম। পরে রিকসা ওয়ালাকে বললাম ভার্সিটির কলাভবনে যাব। একজন রিকসা চালক চিনতে পারলো। সে আমাকে কলাভবনের সামনে নামিয়ে দিয়েছিল।

ঢাবিতে কত সালে ভর্তি হয়েছিলেন। কোন বিভাগে?

আমি ২০০০-২০০১ সালে ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হই। এরপর জাহাঙ্গীরনগর থেকে এসে মৈত্রী হলের গণরুমে উঠি। গণরুমটা কি একটু বলবেন? গণরুম বলতে-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে যারা ভর্তি হয় তারা হলে সিট পাওয়ার আগে এক একটি বড় রূমে অনেকে থাকে। যেমন একটি রূমে ১০/১২ জন কিংবা তার বেশি কিছুদিন থাকতে হয়।

সেখানে থাকতে সমস্যা হয় না?

না বাথরুমে সিরিয়াল ছাড়া আর কোনো সমস্যা হয় না। বরং ওই সময়টা সব ছাত্রীরাই এনজয় করে। এক সঙ্গে অনেকে থাকার মজাই আলাদা। পরে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের ৩০৫ নম্বর রূমে সিট পাই। ওই রূমে আমরা চারজন থাকতাম। বগুড়ার তন্দ্রা, মিতী আর সাভারের আফরোজা মনু ছিল আমার রূমমেট।

মাস্টার্স শেষ করার আগে কোনো জব করেছিলেন কী?

হ্যাঁ আমি তৃতীয় বর্ষ থেকেই কাজ শুরু করি। প্রথম কাজ শুরু সাপ্তাহিক ২০০০ থেকে। সেখানে ৫/৬ মাস কাজ করেছিলাম। তখন সাপ্তাহিক ২০০০ এ ২৪ঘন্টা নামে একটি ফিচার ছাপা হতো। আমার প্রথম রিপোর্ট ছিল ২৪ ঘন্টা। এরপর ঢাকার প্রথম কাজির সাক্ষাতকার এনেছিলাম। এরপর ইউএনবি ও এটিএন বাংলায় ইন্টার্নসিপ করেছি। বাংলাদেশ টু’ডে পত্রিকায় ডিপ্লোমেটিক বিটে ৫/৬ মাস করেছি।

পরে ডেইলি স্টারে জয়েন্ট করি। ওখানেও ৬ মাসের মতো কাজ করেছিলাম। রিপোর্টিং-এ। ওই সময় ডেইলি স্টার থেকে রিপোর্ট করতে খুলনার দাকোপ আর পাইকগাছা গিয়েছিলাম।পাইকগাছায় আগে লোনা পানির কারণে ধান হতো না। এখন কিভাবে ধান হয় সে নিয়ে রিপোর্ট করেছিলাম। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রজেক্টেও কিছুদিন কাজ করেছিলাম। এছাড়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে সাংবাদিকতায় ফেলোশিপ করি।

অনেকতো শুনলাম। এবার চাকরি, বিবাহ, স্বামী, সন্তান, সংসার নিয়ে কিছু বলেন।

হ্যাঁ আমার বিয়ের ঘটনাটাও একটু মজার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবো এটা আমি কখনো ভাবিনি। আমার বন্ধু তাবিউর (বর্তমানে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) আমাকে বললো রাবিতে সার্কুলার দিয়েছে। আমি তেমন আগ্রহী হইনি। ও আমাকে একটি ফরম এনে দিল। আবেদন করলাম। মৌখিক পরীক্ষায় ডাকলো। এর তিনদিন পরই নিয়োগ।

এদিকে আমি আমার বড় ভাবীর ভাই ওহিদুল ইসলাম জামানকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু মা-বড় ভাই কেউ রাজি না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওহিদকে বিয়ে করবো।পরে সবাই রাজি হলো। ২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর বিয়ে হয়েছিল। ওদিকে ৩১ অক্টোবর রাবিতে জয়েন্ট করার ডেট। বউ ভাতে আমি আর উপস্থিত থাকতে পারলাম না। বিয়ের পর দিনই রাজশাহীতে গিয়ে জয়েন্ট করলাম।

এখন কেমন চলছে?

হ্যাঁ ভালো চলছে। স্বামী সন্তান নিয়ে ভালোই আছি। আমার একটি ছেলে। আরিয়ান আল আমিন। ওর বয়স সাড়ে তিন বছর।