১২ ডিসেম্বরে নরসিংদী পাক-হানাদার মুক্ত দিবস

নরসিংদী প্রতিনিধিঃ  নরসিংদীতে পাক-হানাদার মুক্ত দিবস। বিগত প্রায় ৪৫ বছর পূর্বে ১৯৭১ সলের ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জওয়ানদের সহযোগিতায় আকাশপথসহ জল ও স্থল পথে আক্রমন চালিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীদের পরাভূত করার ফলে নরসিংদী হানাদার মুক্ত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে বিগত সময়ের ন্যায় এবারও নরসিংদীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ সরকারী, বেসরকারীভাবে জেলার বিভিন্ন স্থানে নানামূখী কর্মসূচী’র উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

নরসিংদী জেলায় সংঘঠিত যুদ্ধসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীদের উপর পাক-হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে প্রায় ১১৬ জন বীর সন্তান শহীদ হয়েছিলেন। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে খন্ডকালীন যুদ্ধে সদর উপজেলায় ২৭ জন, পলাশে ১১ জন, শিবপুরে ১৩ জন, রায়পুরায় ৩৭ জন, বেলাবতে ১৬ জন ও মনোহরদীতে ১২ জন স্বাধীনতাকামী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বেসরকারী হিসেব মতে শহীদের সংখ্যা আরো বেশী। জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার আব্দুল মোতালিব পাঠান জানান, পাক-হানাদার বাহিনী ও  মুক্তিযোদ্ধাদের পৃথক পৃথক হামলায় ২৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশতাধিক গেরিলা যুদ্ধ, খন্ডযুদ্ধ এবং কয়েকটি মাঝারী আকারের সম্মুখ যুদ্ধের পর অবশেষে নরসিংদী পাক-হানাদার মুক্ত হয়। নরসিংদীতে সরকারীভাবে গণকবরগুলো রক্ষাবেক্ষণে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে সরকারীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে নরসিংদীর প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি উপজেলায় সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে জেলা প্রশাসনিক এলাকায় একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

অপরদিকে তৎকালীন সময়ে পাক-হানাদার বাহিনী’র হাতে নির্যাতিতা ও বীরাঙ্গনা খেতাব প্রাপ্ত নারীরা ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকায় তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
নরসিংদী জেলায় ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হচ্ছে, তৎকালীন সময়ে নরসিংদী শহরের প্রাণকেন্দ্র টিএন্ডটি অফিস বর্তমানে বিটিসিএল প্রধান কার্যালয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর মূল ক্যাম্প দখলের যুদ্ধ, মাধবদীর তারা পুকুরের যুদ্ধ, পাঁচদোনার যুদ্ধ, বেলাব বড়িবাড়ী যুদ্ধ, রায়পুরায় হাটুভাঙ্গার যুদ্ধ, শিবপুরের চন্দনদিয়ার যুদ্ধ, পুটিয়া বাজার ব্রীজের যুদ্ধ, বানিয়াদীর যুদ্ধ, বাজনাব’র যুদ্ধ, শাষপুরের যুদ্ধ ইত্যাদি। এছাড়া নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে পাকবাহিনী স্যাবরজেট বিমান, ২৪ ইঞ্চি মর্টার, হেভী মেশিনগান, লাইট মেশিনগান, চাইনিজ রাইফেল, টমিগান, ৩০৩ বৃট্রিশ রাইফেল ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। তৎকালীন নরসিংদী’র উল্লেখিত যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনী শহরের বড় বাজারে আকাশ ও স্থলপথে অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে বাজারের বিভিন্ন ব্যবসা কেন্দ্রে কর্মরত শত শত ব্যবসায়ী, শ্রমিক, ক্রেতা সাধারণ নিহতসহ লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। এছাড়া পাক-হানাদার বাহিনী সদর থানাধীন চিনিশপুরস্থ দেশের তিতাস গ্যাস এন্ড ট্রান্সমিশন’র প্রধান পাইপ লাইন থেকে নির্মিত আঞ্চলিক শাখার সাব-ষ্টেশনে বোমা ও সেল নিক্ষেপের মাধ্যমে ভয়াভহ অগ্নিকান্ডসহ ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়ে সমগ্র নরসিংদীতে মরণাতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।
অপরদিকে মুক্তিবাহিনী লাইট মেশিনগান, এসএমজি, স্টেনগান, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেল, ডিনামাইট, ৩৬ এইচজি (গ্রেনেড) ও মিত্র বাহিনী জঙ্গিবিমান, ট্যাংক, কামান বিধ্বংশী বিমান, হেভী মেশিনগান, লাইট মেশিনগান, শর্ট মেশিনগান, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেল ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। নরসিংদীর অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অংশে ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, ডিনামাইট এবং স্ট্যানগান, এসএলআর ও পিস্তল রিভলবার ব্যবহার বেশী হয়েছে।
দীর্ঘ ৯ মাস খন্ডযুদ্ধ, গেরিলাযুদ্ধ, সম্মুখ যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর পূর্ব ভারতের  আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এলাকা থেকে মিত্র বাহিনী ঢাকার দিকে যাত্রা করে। মিত্র বাহিনীরা যুদ্ধ বিমান থেকে সেল নিক্ষেপ, স্থলপথে ট্যাংক থেকে ভারী মর্টার সেল নিক্ষেপ, ট্যাংকের ঘুর্নায়মান হেভী মেশিনগানের গুলি বর্ষনের মাধ্যমে নরসিংদীতে অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে। মিত্র বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র সহযোগীদল চতুর্মূখী আক্রমন চালাতে চালাতে নরসিংদী শহরে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে আক্রমন করে। এমতাবস্থায় ১১ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর সকাল ১০ টা পর্যন্ত নরসিংদী শহরের বিভিন্ন এলাকায় উভয় বাহিনীর মধ্যে প্রবল আক্রমনের ফলে ১২ ডিসেম্বর সকাল প্রায় ১০ টায় পাকবাহিনীর সদস্যরা নরসিংদীর স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ সময় পাকিস্তানী সেনারা স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর নিকট প্রায় ৫ হাজার হেভী মেশিনগান, লাইট মেশিনগান, চাইনিজ রাইফেল এবং ১০ লাখ রাউন্ড বিভিন্ন প্রকারের গুলি সমর্পণ করে।
দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের মধ্যে নরসিংদী সদরের মরহুম কাজী হাতেম আলী, মরহুম মোসলেহ উদ্দিন ভূইয়া, মরহুম মেজর (অবঃ) সামসুল হুদা বাচ্চু, মেজবাহ্ উদ্দিন ভূইয়া ইরান, নেভাল সিরাজ, মীর এমদাদুল হক, আলী আকবর, হারাধন সাহা, আমিরুল ইসলাম, হাবিবুল্লাহ বাহার, শহীদ শহীদুল্লাহ বাহার, মনসুর আহমেদ, মনিরুজ্জামান ছোট্র, জগদ্বীশ আচার্য গনেশ ও বর্তমান জেলা কমান্ডার আব্দুল মোতালিব পাঠান, রায়পুরার বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, গয়েছ আলী মাস্টার, ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, আব্দুল আলী মৃধা, নুরুল ইসলাম কাঞ্চন, জয়ধর আলী, জসিম উদ্দিন, কাজী আজিজুল হক, কাজী নূরুল হক, নজরুল ইসলাম, শিবপুরের ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, মরহুম আব্দুল মান্নান ভূইয়া, মজনু মৃধা, মরহুম রবিউল আউয়াল খান কিরণ, আফসার উদ্দিন ভূইয়া, বদরুজ্জামান সেন্টু, তাজুল ইসলাম ঝিনুক, আব্দুল মান্নান খান, তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার ও আজিজুর রহমান ভুলু মাস্টার, পলাশের বিজয় চাটার্জী, হাসানুল হক হাসান, কাজী আবু এমরান, বিধুভূষণ দাস, এনামুল হক, মনোহরদীতে গাজী ফজলুর রহমান, প্রফেসর সাহাবুদ্দিন, সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুল, লিয়াকত হোসেন, তারা মাস্টার, আব্দুর রশিদ, বেলাবতে বাবর আলী মাস্টার, আবেদ আহমেদ, আব্দুল হাই, সমসের আলী ভূইয়া ও মতিউর রহমান মাস্টার প্রমুখ অন্যতম।
সোমবার রাত ১২টা ১মিনিটে দিবসটি পালনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠাণ, জেলার সর্বস্তরের মানুষ বিভিন্ন স্থানে নানামূখী কর্মসূচী’র অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ’র মাধ্যমে দিবসটির শুভ-সূচনা করবে।