১৮ হাজার কোটি টাকার সম্পূরক বাজেট পাস

জাতীয় সংসদে বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট কন্ঠভোটে পাস হয়েছে। এ বাজেট পাসের মধ্য দিয়ে সংসদ ২৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে অতিরিক্ত ১৮ হাজার ৩৭০ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করার অনুমতি দিয়েছে।

এই অর্থ অনুমোদনের জন্য ২৬টি মঞ্জুরি দাবি উত্থাপন করা হয়। এসব দাবির মধ্যে ৪টি দাবির ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। এগুলো হচ্ছে-প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়,স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ। বাকি মঞ্জুরি দাবিগুলো সরাসরি ভোটে প্রদান করা হয়। অবশ্য সব ছাঁটাই প্রস্তাবগুলোই কন্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল’২০১৭ উত্থাপন করলে কন্ঠভোটে পাস হয়।

গত অর্থ বছর শেষে ২৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাজেটের চেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে। সাংবিধানিক নিয়ম অনুসারে যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি তাদের হ্রাসকৃত বরাদ্দের জন্য সংসদের অনুমতির কোনো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে কেবলমাত্র তাদের বরাদ্দই সংসদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এরই প্রেক্ষিত্রে আজ সংসদে এই সম্পূরক বাজেট পাস হয়।

সম্পূরক বাজেটের ওপর মোট ২৬টি দাবির বিপরীতে মোট ১৪৯টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনা হয়। ব্যয় বরাদ্দের বিরোধীতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব এনে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, সেলিম উদ্দিন, স্বতন্ত্র এমপি রুস্তম আলী ফরাজী, জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর ও নূরুল ইসলাম মিলন।

সম্পূরক বাজেটের আওতায় ৫৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিপরীতে ১৮ হাজার ৩৭০ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ খাতে বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। সবচেয়ে কম ৭০ লাখ ৪৩ হাজার বরাদ্দ অনুমোদন পেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া বেশি বরাদ্দ পাওয়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২ হাজার ১৪৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ২ হাজার ৫৫ কোটি ২১ লাখ ৭ হাজার টাকা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক হাজার ৮০ কোটি ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অনুকূলে এক হাজার ১৬৬ কোটি ৭৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা।

বাজেট পাসের সময় এক মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অন্য মন্ত্রীর প্রস্তাব উপস্থাপনের কড়া সমালোচনা করেন ছাঁটাই প্রস্তাব দেয় এমপিরা। তারা বলেন, এখানে বাজেট পাস হচ্ছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ অনেক মন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে অনুপস্থিত। এক মন্ত্রীর পরিবর্তে অন্য মন্ত্রী তার প্রস্তাব তুলে ধরছেন। এটা দুঃখজনক।

এদিকে সম্পূরক বাজেট পাসের আগে এ নিয়ে আলোচনা করেন সরকারি ও বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র এমপিরা। তারা অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের কড়া সমালোচনা করেন। এমপিরা বলেন, যখন বাজেট করা হয় তখন কোন হিসাব করে করা হয়েছিলো। কারা সেসময় বাজেট তৈরি করেছিলেন।

জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, প্রতিরক্ষা খাতের জন্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। যখন বাজেট তৈরি করা হয় তখন কি এ নিয়ে হিসাব করা হয়নি। অন্যদিকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তাদের বাজেটের প্রায় সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। এসব কেন? সম্পূরক বাজেটের ওপর দুই দিনে ১৫ জন এমপি বক্তব্য রাখেন। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের মুল বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বিরোধীতা
এ মন্ত্রণালয় খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দে ছাঁটাই প্রস্তাব করেন ৬ এমপি। তারা হলেন- জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, সেলিম উদ্দিন, স্বতন্ত্র এমপি রুস্তম আলী ফরাজী, জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর ও নূরুল ইসলাম মিলন। পরে কাজী ফিরোজ রশীদ ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে অপরাগতার কথা জানান।

এমপিরা বলেন, প্রতিবছর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়, কিন্তু এসব অর্থ কোন খাতে ব্যয় হয়, সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না- তা বিস্তারিতভাবে জানানো হয় না। জনগণের অধিকার রয়েছে এই খাতে বরাদ্দের টাকা স্বচ্ছভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না।

তারা বলেন, প্রতিরক্ষা খাত হচ্ছে জনগণের খাত। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই। বক্তব্যে তারা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে বলেন, মন্ত্রণালয় ব্যর্থ না হলে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হতো না। প্রতিবছরই এ মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দাবি করে। অথচ তাদের খরচের খাত সুনির্দিষ্ট।

জবাবে সংসদকার্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, প্রতিরক্ষা খাতের জন্য যে টাকা চাওযা হওয়া তা অত্যন্ত যৌক্তিক। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কি কাজ করছেন, তাদের জন্য কি কি কেনা হচ্ছে তা এরইমধ্যে সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে একাধিকবার বলা হয়েছে। এখন কেউ যদি জেনেও না জানার ভান করেন তাহলে আমার কিছু বলার নেই।

তিনি বলেন, আমাদের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের জন্য যে সম্মান বইয়ে আনছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। তাই ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, এ খাতের জন্য এক হাজার ৮০ কোটি ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত খাতে বরাদ্দের বিরোধীতা
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ২ হাজার ৫৫ কোটি ২১ লাখ ৭ হাজার টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ খাতে টাকা বরাদ্দের জন্য অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব উত্থাপন করলে তার বিরোধীতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব দেন জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিন, রুস্তম আলী ফরাজী, ফখরুল ইমাম, নূরুল ইসলাম মিলন ও নুরুল ইসলাম ওমর।

এমপিরা বলেন, সাড়ে তিন বছরে কোন এমপিকে রাজধানীতে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অথচ অর্থমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন প্লট বরাদ্দ দেবেন। এর মধ্যেই আমাদের সামনে এত বিপুল অংকের টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের সেবা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। মানুষকে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

এমপিরা বলেন, সংসদ সদস্যদের আবাসনের সুবিধাই এ মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করতে পারেনি। মন্ত্রীরা সংসদে এসে জানতে পারেন যে তার মন্ত্রণালয়ে এই অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে। তারা আসলে নিজেরাও বলতে পারবেন না কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে। রাজউকের মাধ্যমে এ মন্ত্রণালয় অনেক কাজ করে। আসলে রাজউক হচ্ছে দুর্নীতির আখড়া। দুর্নীতির দায়ে কেউ কেউ এখন জেলও কাটছেন।

জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সবার বক্তব্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বলা হয়েছে, ঢাকায় এমপিদের প্লট দেয়া হয়নি। পাশাপাশি তারা বলেছেন, সারাদেশে আবাসন সমস্যার সমাধান করা। আমরা এরইমধ্যে সারা দেশে আবাসন সমস্যার সমাধানে কাজ করছি। আবাসন খাতে সরকার সামান্য ভূমিকা পালন করে। বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করে। তারা এদিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশের আবাসন সমস্যা একটা বিরাট সমস্যা। এ সমস্যা সমাধান শুধু সরকারের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। বেসরকারি খাতেরও সহযোগিতা লাগবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ৯২৭ কোটি ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দের বিরোধীতা করে ছাঁটাই প্রস্তাবকারী ৬ এমপি বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ন একটি মন্ত্রণালয় এটা। অনেক অঞ্চলে দেখা যায় ৪/৫টা প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, এসব প্রকল্পের কাজ হয় না। যোগাযোগ করলে বলা হয় হবে হবে হবে। তারা বলেন, অতিরিক্ত যে টাকা নেয়া হয়েছে তার ব্যয় যেনো সঠিকভাবে হয় সে বিষয়ে মন্ত্রীকে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।

জবাবে এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এটা একটি উন্নয়নমুখি বিভাগ। প্রতিনিয়ত সড়কের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে। সুপেয় পানির জন্যসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার বিভাগ এখনও আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পুর্ন হতে পারেনি। দেশের জনগণ ও জনগণের চাহিদার প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ খাতে বরাদ্দের বিরোধীতা
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ চাওয়া ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা বরাদ্দের বিরোধীতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব দেন ৬ এমপি। এসময় তারা বলেন, এটি একটি নতুন সৃষ্ট বিভাগ। এখানে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা স্বাভাবিক। কিন্তু কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগকে কিভাবে এক করা হলো? দুটি তো ভিন্ন বিষয়। কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। তাই এটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তারা বলেন, কোন কোন প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত টাকা চাওয়া হয়েছে তা বলা হয়নি।

জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তে কারিগরি ও মাদরাসাকে একটি বিভাগে আনা হয়েছে। এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এই দুটি শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সরকার কাজ করছে বলেই বেশি টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। যার কারণে আজ সম্পূরক বাজেট পাস করানো হচ্ছে। যারা বলছেন, মন্ত্রীরা জানেন না কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। একটি প্রকল্প তৈরি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক ধাপ পার হয়ে একটি প্রকল্প পাস হয়। তাই প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রীরা জানেন না এটা সঠিক নয়।