চিকিৎসক হিসেবে কী যে দুঃসময় পার করছি, কেউ বুঝবে না

ডাঃ রাজীব দে সরকার

করোনা নিয়ে এই মৌসুমে আবার নতুন করে আলাপ-সংলাপ শুরু হলো। শুধু আমরা চিকিৎসক, সেবিকা আর স্বাস্থ্যকর্মীরা জানি, গত ১২ টা মাসে করোনা আমাদের কাছে একটি দিনের জন্যও পুরোনো হয়ে যায় নি।

করোনা হঠাৎ করেই ‘নস্যি’ হয়ে গিয়েছিলো আমাদের দেশের মানুষের কাছে। কিন্তু আসলে, মিডিয়া হাইপ না পেলেও, করোনা এক দিনের জন্যও আমাদের ছেড়ে যায় নি। শুধু আমরা ছেড়ে দিয়েছিলান স্বাস্থ্যবিধি নামের জিনিসটাকে। অথবা স্বাস্থ্যবিধি ঝুলে ছিলো আমাদের থুঁতনিতে।

গত ৭ দিনে আমার আত্নীয়-স্বজন, আমার এলাকার মানুষ এবং পরিচিত কিছু মানুষজনের কাছে থেকে বেশ কিছু ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা, মেসেঞ্জার বার্তা পেয়েছি, যাদের নিজেদের কিংবা তাদের পরিবারের কেউ না কেউ করোনা রোগের লক্ষণ নিয়ে আমাকে নক দিয়েছেন।

অন্যান্য স্বাস্থ্য পরামর্শের পাশাপাশি সবাইকেই করোনার টেস্ট করাতে বললাম। তাতেও ২/১ জন ছাড়া কারো সারা পেলাম না।

৪০ এর বেশী বয়স যাদের তাদেরকে ভ্যাকসিন নেবার ব্যাপারে প্রশ্ন করে উলটো আমিই হতাশ হলাম। সরকার ভ্যাকসিন দিচ্ছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। একটি সুন্দর সাজানো গোছানো সিস্টেমের মাধ্যমে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে এতো সুন্দর নিবন্ধন ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ যা খুব দ্রুত সময়ে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে তৈরী করা হয়েছে।

কিন্তু সেই ভ্যাকসিন এর প্রতিও মনে হয় মানুষের অনীহা চলে এলো। আসলে খুব সহজে যা পাওয়া যায় তার প্রতি আকর্ষণ আর থাকে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চৌকস কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় যে অতি আরাধ্য ভ্যাকসিন আমরা পেলাম, অনেক দেশ এখনো সেই ভ্যাকসিন এর দিকে বুভুক্ষের মতো চেয়ে আছে। অথচ আমরা পেয়েও “হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছি”

ফলে যা হবার তাই হলো। ক্রমাগত চরিত্র পালটানোর ক্ষমতা সম্পন্ন করোনা ভাইরাস এর ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এদেশে ঢুকে পড়লো। ইনফেকশন এর পরিমাণ ঝড়ের গতিতে বাড়তে শুরু করলো। আমার আশে পাশের মানুষগুলোর আক্রান্ত হবার খবর প্রতিনিয়ত পাচ্ছি।

ফোন গুলো পেয়ে এখন আমি খুব নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করি। কারন আমি জানি, এদের কারো শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে হাসপাতালে একটা বেডও আমি এদেরকে যোগাড় করে দিতে পারবো না।

একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি অনেক বাজে একটা সময় পার করেছি করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত অবস্থায়। এ এক দুঃসময়। কোভিড ইউনিটে দেখেছি, একসাথে অনেক গুলো মানুষ শ্বাস নেবার মতো স্বাভাবিক একটি কাজ করতে গিয়েও কাতরাচ্ছেন। হাই-ফ্লো অক্সিজেন দিয়েও তাদের স্টেবল করা যাচ্ছে না! সৃষ্টিকর্তা বাতাস ভরা অক্সিজেন দিয়েছেন। কিন্তু সেই অক্সিজেন প্রবল শক্তি দিয়েও বুক ভরে টেনে নিতে না পারার যে কষ্ট, সেটা যার হয়নি, তাকে বোঝানো যাবে না।

আমাদের জাতির আরো একটা ভালো গুণ দোষারোপ করা। নিজের ভুলটা আমরা দেখি না। গত কয়েকটা মাস বাসা থেকে হাসপাতাল আর হাসপাতাল থেকে বাসা যাওয়ার সময় আমি শতকরা ১০ ভাগ মানুষের মুখেও মাস্ক দেখি নি। শারীরিক দূরত্বের কোন বালাই তো ছিলোই না। ঘন্টায় ঘন্টায় হাত ধোয়ার যে নির্দেশনা ছিলো, আন্দাজ করতে পারি তা কতো নিষ্ঠার সাথে পালিত হয়েছে!

এ কোন ধরণের স্বাস্থ্যবিধি!!
এ কোন ধরণের প্রহসন!!

একটা মহামারী, এতোগুলো মৃত্যু – এগুলো কি আমরা ভুলে বসে আছি? নাকি নিরুৎসব মৃত্যুও আমাদেরকে আর নাড়া দেয় না? মৃত্যুর হার শতকরা কতো, এই আলোচনাই অর্থহীন। কারন যার পরিবারে একজনও মারা যাচ্ছেন, তার কিন্তু ১০০% ক্ষতিই হলো। তাই শতকরার পরিসংখ্যান বাবা হারানো ছেলে কিংবা ছেলে হারানো বাবাকে বলা আরেকটা প্রহসন!

আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন,
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, বাইরে যারা কাজ করেন, যারা অফিসে কাজ করেন, তাদের প্রতিদিন ৬/৭ টি সার্জিকেল মাস্ক লাগার কথা। কিন্তু একটি সার্জিক্যাল মাস্ক ৬/৭ দিন চালাতেও দেখেছি মানুষকে। হালকা নীল রঙের মাস্ক ধুলোয় কালো হয়ে গেছে আমাদের ‘মোডিফাইড’ স্বাস্থ্যবিধির কল্যাণে।

সনাক্তের হার ১৩% পেরিয়ে যাচ্ছে। সেটা পেরোচ্ছে কারন হাসপাতালের আইসোলেশনে থাকা রোগীদের কিংবা হাসপাতালের নন-কোভিডে থাকা রোগীদের লক্ষণ ভিত্তিক কোভিড টেস্ট করানো হচ্ছে। করোনা আক্রান্তের লক্ষণ নিয়ে কেউ স্বপ্রণোদিতে হয়ে টেস্ট করালে এই সংখ্যা আরো অনেক অনেক বাড়তো!

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ইতিমধ্যেই এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেক গুলো প্রস্তাবনা/নির্দেশনা।দিয়েছে। সেগুলো কোন দপ্তর এখনো আমলেই নেয় নি। বিসিএস এর প্রিলিমিনারী পরীক্ষাটাও হলো। কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন প্লিজার ট্রিপ গুলোও চলছে। ইউকে ফ্লাইট গুলো উঠছে নামছে। কোয়ারেন্টাইনে থেকে বিয়েশাদি হচ্ছে। সামনের সপ্তাহে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। ইনভিজিলেটর হিসেবে দায়িত্বপত্র হাতে পেলাম!

সব কিছুই হচ্ছে!!
সব কিছুই হবে!!

শুধু এক দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছি আমরা, আমরা চিকিৎসকেরা, আমরা নার্সরা, আমরা স্বাস্থ্য কর্মীরা। যাদের ছুটি নেই। যাদের ছুটি ছিলো না। ২৪ ঘন্টা আরোগ্য নিকেতন গুলো খোলা রাখবো আমরা। দুঃসময়ের নদীটা পার করে দেবো আপনাদের। নিজেরা দুঃসময়কে কাঁধে করে নিয়ে আপনাদের মাস্ক-বিহীন ঘুরে বেড়ানোর সুসময়টা এনে দেবো!

শেষে একটা ঘটনা শেয়ার করিঃ
৩ মাস আগে লিফটে করে নামছিলাম আমরা ৩/৪ জন। সবাই সবার অপরিচিত। লিফটে শুধু আমিই মাস্ক পড়া। একজন হঠাৎ করে বলে উঠলো, “দ্যাখেন, করোনা নিয়ে আমাদের ডাক্তাররা কি ভয় টাই না দেখিয়েছিলো। দেশে নাকি মড়ক লাগবে। হাসপাতালে কোন সীট পাওয়া যাবে না। কি একটা চিটিং বাজি! সবই শালাদের বিজনেস”

আমি লিফটের ছাদে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, “ঈশ্বর, আমার এই জাতিকে তুমিই রক্ষা করো”

======

লেখাঃ


ডাঃ রাজীব দে সরকার
রেজিস্ট্রার (৩৩ বিসিএস)
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক,
৩৩ বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন।
প্রচার ও জনসংযোগ সম্পাদক,
বিএমএ, রাজবাড়ী জেলা শাখা।
ইমেইলঃ rds@mis.dghs.gov.bd

চিকিৎসক হিসেবে কী যে দুঃসময় পার করছি, কেউ বুঝবে না