‘ঢাকার শিশুদের ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে’

বায়ু দূষণের প্রভাব নিয়ে সর্বশেষ গত বছর প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খানের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর ৬টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপর জরিপ করা হয়। সেই জরিপে উঠে এসেছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে।

ওই জরিপ কমিটিতে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মালেক ও প্রফেসর নুরুজ্জামান৷ এই গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এই তথ্যের কথা জানান বাপা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, ‘‘এই গবেষণা থেকেই বোঝা যায় আমরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছি এবং সামনে আরো কতটা খারাপ সময় আসছে।”

‘ঢাকার শিশুদের ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে’
ঢাকার অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে মাইলের পর মাইল ইটভাটা। ছবি: আমিনুল ইসলাম।

তিন বছরের মধ্যে দূষণ অনেক বেড়েছে:

গত তিন বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ু ধারাবাহিকভাবে অস্বাস্থ্যকর হয়ে চলেছে৷ খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) তথ্যে এ কথা বলা হয়েছে৷ ২০১৪ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি বাতাসের মান নির্ণয়ে দেখা যায় ১৭২ একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স), ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি একই মাপে দেখা যায়, একিউআই’র পরিমাণ ৩৬১৷ স্ট্যান্ডার্ড ফর বাংলাদেশেরের (এনএএকিউএস) পরিমাপে এই তথ্য পাওয়া গেছে৷ ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিউএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ১৬০০ শহরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বাতাসের শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২৩ তম৷

এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদফতর সংবাদপত্রে এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে৷ সেখানে অধিদফতরের মহাপরিচালক উল্লেখ করেন, নির্মল বায়ু সুস্থ জীবনের পূর্বশর্ত৷ ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বায়ু দূষণজনিত স্বাস্থ্যহানি ও এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ মূলত দেশে শিল্পায়ন, নগরায়ন ও অবকাঠানো নির্মাণ হচ্ছে৷ ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে৷ নরওয়ে ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় পরিবেশ অধিদফতর গবেষণা করে দেখেছে, বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা ৫৮ শতাংশ, রোডডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী৷

দূষণের কারণে বাড়ছে রোগ-ব্যাধি:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগের জন্য একটি বড় কারণ একটি বায়ু দূষণ৷ দীর্ঘ মেয়াদে ধূলার মধ্যে থাকার কারণে অ্যাজমা, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসনালী সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ৷ এই ধরনের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ এতে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবার, এমনকি রাষ্ট্রও৷

‘ঢাকার শিশুদের ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে’অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে ৮৫ লাখ মানুষ শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমায় ভুগছে৷ ৭৫ লাখ মানুষ ব্রঙ্কাইটিস এবং সিওপিডিতে আক্রান্ত৷ এসব শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগের জন্য ধূলার দূষণ যে অন্যতম কারণ এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷

পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক জিয়াউল হক ঢাকার একটি দৈনিককে বলেছেন, ‘‘সিএএসই (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভারনমেন্ট) এর অধীনে দূষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন। দূষণ ঝুঁকি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বাতাসের মান নিয়ে প্রতি মাসে চার্ট প্রকাশ করা হয়ে থাকে৷ ডিওই মহাপরিচালক মনে করেন, বাতাসকে দূষণমুক্ত রাখতে সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে৷ এজন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে কিছু নির্দেশনা মেনে চলতে অনুরোধ করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ভাল মানের জ্বালানি ব্যবহার করে, যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করে, গাছ লাগিয়ে আমরা এই বায়ু দূষণ অনেকাংশে কমাতে পারি।”

দূষণ রোধে পদক্ষেপ:
সম্প্রতি বায়ু দূষণ কমাতে ভারত ও চীনে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল হক বলেন, ‘‘বায়ু দূষণ কমিয়ে আনতে সরকার কাজ করে চলেছে৷ ইট ভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া রাজধানীর বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ৷ পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইট ভাটাগুলোকে সরানোর পরিকল্পনা যথাযথভাবে কাজ করছে না৷ আর সবচেয়ে বড় কথা ঢাকার বায়ু দূষণ রোধে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি৷ জিয়াউল হকের মতে, অর্থনীতি ও পরিবেশ দু’টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বায়ু দূষণে সরকারকে নতুন কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷’’

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড মিটফোর্ড হাসপাতালের স্টোরেড অ্যান্ড মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু রায়হান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বায়ু দূষণের কারণে আমাদের অন্তত ১০ শতাংশ রোগী বেড়ে গেছে৷ পাশাপাশি ধূমপানের কারণে যে ধরনের সমস্যা দেখা দেয় অধূমপায়ী নারীদের সেই ধরনের সমস্যা ধরা পড়ছে৷ এটা আসলে বায়ু দূষণের কারণেই হচ্ছে৷ নানা রোগব্যাধির পাশাপাশি আয়ুও কমে যাচ্ছে৷”

দূষণ রোধে রাজশাহীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত:
দুই বছর আগে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি৷ অন্য জরিপ বলছে, দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে, নদী-খালে মাছ বা প্রাণিও টিকতে পারছে না৷ পরিবেশ সংগঠনগুলোর জরিপ বলছে, মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে রাজধানীর চারপাশে অবস্থিত নদীগুলোর মাছসহ অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন৷ স্থানভেদে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে৷ এর মধ্যেই বসবাস করছে দুই কোটির ওপর মানুষ৷

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘‘বাংলাদেশের একটি শহর রাজশাহী৷ শহরটি দেড় বছরের মধ্যে বায়ু দূষণের মাত্রা ৬৭ শতাংশ কমিয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। চীনের গুয়াংজু ও সাংহাই শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রাজশাহী দ্রুত বায়ু দূষণ রোধে সেরা হয়েছে৷ অথচ সেই দেশের রাজধানীর এই অবস্থা! সেই সময় বিবিসি, সিএনএস রিপোর্ট করে রাজশাহীর মেয়র ও প্রধান প্রকৌশলীয় ভূয়সী প্রশংসা করেছিল৷ রাজশাহী প্রমাণ করেছে কীভাবে বায়ু দূষণ কমানো যায়৷ আমরা সেই প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে ভালো ফল পেতে পারি।”