“বর্তমান সময় উদ্যোক্তা হওয়ার” ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সামাজিক উদ্যোক্তা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রফেসর ড. অচ্ছুত সামন্ত

কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্স ও ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্সের সাথে সম্পাদিত চুক্তি বিনিময় করছেন ভারতের বিখ্যাত কেআইআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডাসট্রিয়াল টেকনোলজি-KITT) ও কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্স (KISS) এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. অচ্ছুত সামন্ত ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ সবুর খান। পাশে রয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনের প্রথম সেক্রেটারী মিঃ জে পি মুখার্জী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. এম এম মাহাবুব উল হক মজুমদার।

শিক্ষা ডেস্কঃ  ‘বর্তমান সময় হচ্ছে উদ্যোক্তা তৈরির এবং উদ্যোক্তা হওয়ার সময়। সারা পৃথিবীতে তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজ নয়। এজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় এবং হৃদয়ে স্বপ্ন ধারণ করতে হয়।’

আজ ২৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত “সামাজিক উদ্যোক্তা” শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ভারতের বিখ্যাত কেআইআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডাসট্রিয়াল টেকনোলজি-KITT) ও কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্স (KISS)  এর  প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. অচ্ছুত সামন্ত।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিলনায়তন ৭১-এ অনুষ্ঠিত সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনের প্রথম সেক্রেটারী মিঃ জে পি মুখার্জী। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ সবুর খান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. এস  এম মাহাবুবুল হক মজুমদার ও  স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্যারিয়ার ডেভেলাপমেন্ট সেন্টারের পরিচালক আবু তাহের খান।

ড. অচ্ছুত সামন্ত বলেন, “দেশের তরুন সমাজকে দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই সমাজ থেকে ক্ষুধা দারিদ্র  দূর  করা সম্ভব। দারিদ্র দূরীকরনে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখন থেকে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও  কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্স (KISS)  এ ইন্টার্নশীপ করতে পারবে।”

সেমিনারে প্রফেসর ড. অচ্ছুত সামন্তের জীবনীর উপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। ডকুমেন্টারি দেখে উচ্ছস্বিত প্রশংসা করে ড. অচ্ছুত সামন্ত বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিয়েছি, কিন্তু কোথাও আমাকে নিয়ে কেউ ভিডিও তৈরি করেনি। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করে যে সম্মান দেখায় তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জে পি মুখার্জী বলেন, উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থাকলে এবং কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলে যে কেউ জীবনে সফল হবেন। ড. অচ্ছুত সামন্তের জীবন থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই।

অনুষ্ঠানের সভাপতি  মোঃ সবুর খান বলেন, “সমস্যার অপর নাম সুযোগ। ড. অচ্ছুত সামন্ত ছোটবেলা থেকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন এবং সমস্যাগুলোকে সুযোগে পরিণত করেছেন। সেজন্য আজ তিনি সফল ব্যাক্তিত্ব।”

সেমিনার শেষে কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স (কওঝঝ) ও ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্স এর সাথে বিভিন্ন অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুদের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও উন্নত জীবনমান নিশ্চিতকল্পে একটি পারস্পরিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। কেআইআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডাসট্রিয়াল টেকনোলজি-KIIT) ও কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্স (KISS)  এর পক্ষে মিঃ আর এন দাস, সেক্রেটারী , কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সাইন্স (KISS) ও কেআইআইটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পক্ষ্যে রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল হক  এ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন।

সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কেষাধক্ষ্য হামিদুল হক খান,  রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. ইঞ্জিনিয়ার এ.কে.এম ফজলুল হক, মেজর জেনারেল (অব) জীবন কানাই দাশ, পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ সুফি মিজানুর রহমান, এইচআরডিআই এর ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ এ সোবহানী, স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান প্রমুখ

ভারতের উড়িষ্যার আদিবাসী অঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার মানুষের জীবন বদলে দিয়েছেন ড. অচ্ছুত সামন্ত। তিনি আদিবাসী ছিন্নমূল শিশুদের জন্য ভারতের ভুবনেশ্বরে গড়ে তুলেছেন দুটি বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—কলিঙ্গ ইন্সিটিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি (কিট) ও কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোস্যাল সায়েন্স (কিস)। অচ্ছুত সামন্তকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে মূলত কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স এবং এর ১৫ হাজার আদিবাসী ছাত্রছাত্রী। এখানে পড়ার সুযোগ রয়েছে প্রথম শ্রেণি থেকে একদম স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, বিনোদন, খেলাধুলা, স্বাস্থ্যসেবা, কম্পিউটার ল্যাব, কনফারেন্স ল্যাব ও ওয়াই-ফাই সিস্টেমের ব্যবস্থা। এছাড়া এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে পায় কারিগরি প্রশিক্ষণ।

অচ্ছুত সামন্ত ১৯৬৫ সালে ভারতের উড়িষ্যার এক ছোট্টগ্রাম কটাক্কার কালাব্রাঙ্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম অনাদীচরণ এবং মায়ের নাম নীলিমা রানি। যখন ৪ বছর বয়স অচ্ছুত সামন্তের তখন তার পিতা পরলোক গমন করেন। বাবাকে হারিয়ে নিদারুণ দুর্দশা নেমে আসে সামন্তের পরিবারে। কারণ বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এ অবস্থায় সংসারের হাল ধরতে মায়ের সঙ্গে অন্যের বাসায় কাজ শুরু করেন ছোট্ট সামন্ত। এর মধ্য দিয়েই কালাবাঙ্কের সরকারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে অদম্য অচ্ছুত এবং পরবর্তীতে তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন রসায়ন শাস্ত্রে, উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাস্টার্স শেষ করেই চাকরিতে ঢুকে যান  মহেশ্বরী কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। এই কলেজে প্রায় ১০ বছর শিক্ষকতা করেন অচ্ছুত সামন্ত। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। তাই সুখের জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে পা বাড়ালেন সমাজ সেবায়। সিদ্ধান্ত নিলেন দুস্থ আদিবাসীদের জীবন পরিবর্তনের  জন্য একটি দক্ষ উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তুলবেন। কিন্তু ততোটা আর্থিক সামর্থ ছিল না তার। তাতে কি? নিজের জমানো ৫ হাজার টাকা সম্বল নিয়েই মাঠে নামলেন। এভাবেই ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু হলো কেআইআইটি ও কেআইএসএস নামের দুটি বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।

কিট এর শিক্ষার্থীদের ফি দিয়ে তিনি কিস পরিচালনা শুরু করেন। কিন্তু কিট থেকে কিস এর যাত্রা এত সহজ ছিল না। অনেক লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। প্রথম দিকে শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ২৫ জন। কারণ আদিবাসীরা তার সন্তানদের ঘর থেকে অন্য কোথাও যেতে দিতে চাইতেন না। ফলে শিশুদের স্কুলে আনতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অচ্ছুত সামন্তকে। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় কিট একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এখানে প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছ। বর্তমানে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বলে রাখা ভালো, কিট এর শিক্ষার্থীদের প্রদেয় ফিসের ১০ শতাংশ ব্যয় হয় কিস এর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা পরিচালনার জন্য। আর কিট এর সকল শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের ৩০ ভাগ প্রদান করা হয় কিস পরিচালনা ফান্ডে। কারণ কিসের দুস্থ শিক্ষার্থীদের  থাকার জন্য হোস্টেল, চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সার্ভিস, তিন বেলা খাবার, তার মধ্যে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার প্রদান করা হয়। খাবারগুলো ভরপুর পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ।

ড. সামন্ত নিজের সাথে সাথে মায়ের স্বপ্ন ও পূরণ করছেন। তার মায়ের স্বপ্ন ছিল, তার গ্রাম কালাব্রাঙ্কাকে একটি স্মার্ট বিদেশি শহরে পরিণত করতে হবে। মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে লাগাতার কাজ করে যাচ্ছেন ড. অচ্ছুত। কালাব্রাঙ্কা এখন ভারতের প্রথম গ্রাম, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য বিমা রয়েছে। এটি গ্রাম হয়েও শহরের মত সকল সুযোগ রয়েছ। যেমন হাইস্কুল থেকে কলেজে পড়ার সুবিধা, পোষ্ট অফিস , ব্যাংক , ইন্টারনেট আরো কত কি!!

কিস-এর সাফল্যের জন্য ড. সামন্থ বলেন, কিস-এর উন্নতি ও সাফল্যের জন্য অনেক মানুষ তাকে অনেকভাবে সাহায্য করেছেন। তিনি কেবলি তা ফেরত দেবার প্রতিদান চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, আমি আমার জীবনের ২৫ বছর ক্ষুধার জন্য কষ্ট করেছি। এখন আমি হাজার শিশুর ক্ষুধামুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি।

অচ্ছুত সামন্ত এ পর্যন্ত ২৫টি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ২০০০ সাল থেকে ‘খুদে মিস ইন্ডিয়া’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছেন। এছাড়া মহাত্মা গান্ধীর স্মরণে একটি আদিবাসী জাদুঘর নির্মাণ করছেন যার নাম ‘গান্ধী গ্রাম’। তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দক্ষিণ কোরিয়ার হানসিওসহ ভারতের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ থেকে পেয়েছেন নানা পুরস্কার।

বিডিসংবাদ/এএইচএস