‘আমরা সিনিয়রদের দোয়া নিয়ে কাজ করেছি’

নায়করাজ রাজ্জাক। সোমবার ৭৬ বছর বয়সে পা রাখতে যাচ্ছেন চলচ্চিত্রের জীবন্ত এ কিংবদন্তি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না। চলচ্চিত্রই তার প্রাণ। এই চলচ্চিত্রের কারণে তিনি কোটি দর্শকের কাছে আজ নায়করাজ। বাংলাদেশের একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে তিনি অনেক গর্ববোধ করেন। জন্মদিনের দুদিন আগে দেশীয় চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

গুণী এ অভিনেতা বলেন, চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরার চেষ্টা করতে হবে। এর আগেও চলচ্চিত্র নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। উর্দু ছবি যখন চলছিল তখন ভালো বাংলা ছবি দিয়েই চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরাতে হয়েছে। তখন জান বাজি রেখে কাজ করেছি আমি। শুধু আমি না পরিচালক জহির রায়হান, কাজী জহির, মোস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, মিতাসহ চলচ্চিত্রের অনেকে যার যার জায়গা থেকে ভালো কিছুর জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তখন চলচ্চিত্র একটা পরিবার ছিল। তখন আমরা যারা কাজ করতাম আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল। একে অপরকে সম্মান করতাম। টাকার পেছনে দৌঁড়াতে হয়নি আমাদের।

বাংলা চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে নায়করাজ আরো বলেন, আগে প্রযোজকরা ছবি বানানোর পর যে টাকা লাভ করেছে তা দিয়ে আরও ভালো কিছু ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছে। শিল্পীরাও যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট থেকে ভালো ভালো কাজ করেছে। তখন আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল যে, চলচ্চিত্র শিল্পটাকে ভালো একটা অবস্থানে নেয়া। এখন যারা আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে আছি তাদের অনেকের কথা ভেবে আমার দু:খ লাগে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। আমি যখন টপ হিরো তখন চেষ্টা করেছি বাংলা ছবিকে শীর্ষে নিয়ে যেতে। এখন শিল্পীসত্ত্বা বিষয়টি নেই। আগে আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, খলিলসহ যেসব সিনিয়র অভিনেতা কাজ করতেন তাদের দোয়া নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এখন অভিনয়শিল্পীরা শুধু গ্ল্যামার আর টাকা খুঁজছে। আর অন্য কোনো চিন্তা করছে না। এভাবে তো কোনো ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রে খুব কমই অভিনয় করছেন নায়করাজ। শুধু নায়ক হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও বেশ সফল তিনি। সর্বশেষ ‘আয়না কাহিনী’ ছবিটি নির্মাণ করেন রাজ্জাক। নায়ক হিসেবে তিনি প্রথম অভিনয় করেন জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ ছবিতে। এতে তার বিপরীতে ছিলেন সুচন্দা। অসংখ্য জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। নায়করাজ প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ‘কি যে করি’ ছবিতে অভিনয় করে। এরপর আরও চারবার তিনি জাতীয় সম্মাননা পান। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার।

শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ বলে এখন আর অভিনয় করছেন না তিনি। চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে রাজ্জাক বলেন, ইন্ডাস্ট্রি চালাতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সত্যি বলতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এখন যোদ্ধা নেই। এখন এখানে কেউ কাউকে শ্রদ্ধা করে না। আমি চাই ইন্ডাস্ট্রি ভালো চলুক। মনের দু:খে এখন আর এফডিসিতে যেতে ইচ্ছে করে না। দু:স্থ শিল্পীদের দিকে তাকানো যায় না। কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আমার সময়ে ৩০০ সিনেমা হল থেকে ১২০০ সিনেমা হল হয়েছে। আর এখন দিনের পর দিন সিনেমা হল কমছে। ববিতা, কবরী, সুচন্দা কেউই তো এখন আর কাজ করছে না। এখন তো অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় আইটেম গানের নামে মেয়েরা নাচছে। আর আমাদের সময়ে নায়িকারা শাড়ী আর হিরোরা পাঞ্জাবী পরে দর্শকদের সিনেমা হলে বন্দি করে রেখেছিল।

বাংলা ছবির জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি জানতে চাইলে সবশেষে রাজ্জাক বলেন, বাংলা ছবির মতো বাংলা ছবি চালালে অবশ্যই চলবে। ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’ ছবিগুলো তো দর্শক ঠিকই দেখেছে। আমার কথা হচ্ছে যেটা আমাকে খাওয়াবে তুমি, সেটা ভালো করে খাওয়াও। তুমি শুটকি মাছ খাওয়ালে সঠিকভাবে রান্না করে খাওয়াতে হবে। এলোপাথারি রান্না করলে তো হবে না। একজন শিল্পী হিসেবে আমার কোনো দু:খ নেই। আমার আক্ষেপ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থার জন্য। এই শিল্প দাঁড় করানোর কোনো উপায় দেখছি না আর। শিল্পীদের ইন্ডাস্ট্রিকে ভালোবাসতে হবে। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। চলচ্চিত্র নিয়েই প্রতিনিয়ত ভাবেন নায়করাজ। চলচ্চিত্র নিয়েই তিনি থাকতে চান।