‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’

মুনমুন বলেন, ‘অনেকে সামাজিক দায় নিয়ে কথা বলছেন। আমি ভেবে পাই না আমাদের শিল্পের যে অবস্থা তাতে র্অথকড়ি খরচ করে দায়ের প্রশ্ন কেন? শিল্পকে ভালোবেসে ফরীদি স্যারের মতো মানুষ কাজ করেছেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন এটা ক’জনে পারে? চাইলে তিনিও টাকার পেছনে ছুটে অনেক টাকার মালিক হতে পারতেন কিন্তু সেটাতো করেননি। ওনাদের শ্রদ্ধা করতে না পারলে সে লজ্জা আমাদেরই।’

জাঈনতাহুর শামস্: তিন দশকে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে। সব ক্ষেত্রেই যোগ করেছেন বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। সাদামাটা জীবনযাপনের চলাচলেই পথ হেঁটেছেন জীবনভর। অথচ মনে-প্রাণে ছিলেন দারুণ রঙে রঙিন এক উজ্জ্বল মানুষ। তিনি হুমায়ুন ফরীদি। সম্প্রতি ফেসবুকে ‘ফরীদির জন্য একুশে পদক’ শিরোনামে একটি গণস্বাক্ষর অভিযান চালাচ্ছে তার ভক্তরা। শক্তিমান প্রয়াত এই অভিনেতা জীবদ্দশায় জাতীয় পদক পেলেও অজানা কারণে উপেক্ষিত হন একুশে পদক থেকে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলেছি বিভিন্ন শাখার শ্রদ্ধাভাজনদের সঙ্গে।

হুমায়ুন ফরীদির মৃত্যুর পর খ্যাতিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, ‘তার পুরো শরীরেই অভিনয় ফুটে উঠতো। তিনি যখন অভিনয় করতেন তখন হাত নাড়তেন, পুরো শরীর দোলা দিত।’

প্রয়াত কৌতুক অভিনেতা ফরিদ আলী বলেছিলেন, ‘ফরীদি নিজেই একটা একাডেমি ছিলেন। অভিনয় কি, কিভাবে করতে হয় তা তার মধ্যে দেখতাম।’

ফরীদির মৃত্যুর পর শংকর সাঁওজাল বলেছেন, ‘তিনি অভিনয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংস্কৃতি লালন করতেন। তার অভিনয়ে দর্শক মনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতো।’

আর ফরীদি নিজে বলতেন, ‘অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারি না আমি’।

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
পরিচালক আজিজুর রহমান। ছবি: আমিনুল ইসলাম।

বিশিষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, “আমার সঙ্গে ‘জিদ’ (শাবনাজ-নাঈম) ছবিতে ও কাজ করেছে। খুবই শক্তিশালী অভিনেতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র, নাটক-মঞ্চ অভিনেতা যার গুণের সীমা নেই। ফরীদির মত অভিনেতা বছর বছর জন্ম নেয় না। একুশে পদক দেয়া হলে প্রকারন্তরে রাষ্ট্রই সম্মানিত হলো। যদি বেঁচে থাকতে পেতেন সেটা আরো সম্মানের হতো।”

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ। ছবি: সংগৃহীত।

ফরীদির সহশিল্পী খ্যাতিমান জাতীয় চলচ্চিত্র পদকজয়ী অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, ‘ওর মতো অভিনেতার স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়ে না। তবু রাষ্ট্রীয়ভাবে পদকের দাবি উঠেছে যেহেতু আশা করছি কর্তৃপক্ষ ওকে ভাববে।’

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
চিত্রনায়িকা অরুণা বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত।

একই দাবি চাঁপাডাঙার বৌখ্যাত নায়িকা ও নির্মাতা অরুণা বিশ্বাসের। তবে তিনি বলেন, ‘গণসাক্ষর করে তার মতো অভিনেতাকে পদক অর্জন করতে হবে কেন? তিনি বেঁচে থাকতেই বিবেচনা করা দরকার ছিলো। পদক না পেলেও দর্শকের ভালোবাসাই তার বড় পদক বলে মনে করি।’

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর। ছবি: সংগৃহীত।

তার মতো অভিনেতাকে পদক দিতে ফরীদি অভিনীত ছবির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, ‘ফরীদি সাহেব তুখোর অভিনেতা। ওনার অভিনয় নিপুনতা দর্শকদের হৃদয়ে এখনও গেঁথে আছে। পাশাপাশি তিনি একজন ‍মুক্তিযোদ্ধাও তাই রাষ্ট্রীয় পদক তার অনেক আগেই পাওয়া উচিৎ ছিল আশা করছি সরকার বিবেচনা করবে।’

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
বরেণ্য পরিচালক সি বি জামান। ছবি: সংগৃহীত।

এ ব্যাপারে সিনিয়র পরিচালক সি বি জামান, মালেক আফসারী এবং আব্দুল আউয়াল পিন্টু তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পদকটি কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া উচিৎ নয়। রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদের বলি হয়েছে অনেক যোগ্য ব্যক্তি দেশের জন্য যাদের অবদান ঢের। ফরীদি সাহেব তেমন একজন ব্যক্তি। ভালো লাগতো যদি তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় পেতেন। এখন এ পদক পাওয়া না পাওয়া তার জন্য সমান। কারণ দর্শক তাকে মনে রেখেছে এটাই বড় পুরস্কার।’

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
পরিচালক মালেক আফসারী: ছবি: সংগৃহীত।

চিত্র সম্পাদক আতিকুর রহমান মল্লিক ও অবসকিওরের ভোকালিস্ট টিপু বলেন, ‘হুমায়ুন ফরীদির এ পদকটি পাওয়া উচিৎ।’

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
চিত্র সম্পাদক আতিকুর রহমান মল্লিক। ছবি: আসিফ আলম বাবু।

অপরদিকে চলচ্চিত্র গবেষক ও ফটোসাংবাদিক মীর শামসুল আলম বাবু তার প্রকিক্রিয়ায় জানান, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ফরীদি থেকেও শক্তিশালী মেধাসম্পন্ন অভিনেতা/অভিনেত্রীর বিচরণ ছিল বা আছে এটা ফরীদি ভাইয়ের কথা। অনেককেই রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়নি। ফরীদিকে মরনোত্তর পদক দিলে এমন অনেকেই আছেন যাদের পদক পাওয়ার দাবিটা জোড়ালো হবে।’

ফরীদি ভাইয়ের জীবিত অবস্থায় পদকটি পাওয়া উচিৎ ছিল মন্তব্য করে মঞ্চ ও টিভি অভিনেত্রী কাজী শিলা বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যদি রাজনীতির বাইরে গিয়ে যথোপযুক্ত সময়ে একজন ব্যক্তিকে সম্মান জানান সেটার চেয়ে আনন্দের কিছু নেই। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মরনোত্তর পদকে তৃপ্তি কোথায়?’

একইভাবে হুমায়ুন ফরীদির একুশে পদক পাওয়া কাঙ্খিত যোগ্য উল্লেখ করে চিত্রনায়িকা মুনমুন বলেন, ‘স্যারের তো জীবিত অবস্থায় পাওয়া উচিৎ ছিলো। যাইহোক দাবি উঠেছে, আমারও দাবি অন্ততপক্ষে এবার রাষ্ট্র তাকে যোগ্য সম্মানটুকু দেবে।’

‘দর্শকের ভালোবাসাই ফরীদির বড় পদক’
চিত্রনায়িকা মুনমুন। ছবি: সংগৃহীত।

এক প্রশ্নের জবাবে মুনমুন বলেন, ‘অনেকে সামাজিক দায় নিয়ে কথা বলছেন। আমি ভেবে পাই না আমাদের শিল্পের যে অবস্থা তাতে র্অথকড়ি খরচ করে দায়ের প্রশ্ন কেন? শিল্পকে ভালোবেসে ফরীদি স্যারের মতো মানুষ কাজ করেছেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন এটা ক’জনে পারে? চাইলে তিনিও টাকার পেছনে ছুটে অনেক টাকার মালিক হতে পারতেন কিন্তু সেটাতো করেননি। ওনাদের শ্রদ্ধা করতে না পারলে সে লজ্জা আমাদেরই।’

অপরদিকে কবি-ছড়াকার আলমগীর রেজা চৌধুরী, বিলকিস আরা ক্ষমা, ইমরান রহমান, জিয়া হক তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান, ‘হুমায়ুন ফরীদি কেন একুশে পদক পাবেন না? এই গুণী-জনপ্রিয় শিল্পীর জন্য গণস্বাক্ষর অভিযান করছি আমরা— এটা আমাদের জন্য লজ্জার।গণস্বাক্ষর করতে হবে কেন? তিনি তো অভিনয়কালেই একুশে পদকের যোগ্য ছিলেন। আমরা সত্যিকারের গুণীকে সম্মান দিতে পারি না। এই সংস্কৃতি জিইয়ে রাখা সত্যিই অকল্যাণকর।’

উল্লেখ্য, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি মঞ্চ-টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র, সব জায়গায় তিন দশক ধরে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।

হুমায়ুন ফরীদি টিভি নাটকে প্রথম অভিনয় করেন আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এ। তার অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘নীল আকাশের সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চাঁনমিয়ার নেগেটিভ পজেটিভ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘সংশপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘বিষকাঁটা’, ‘ভবের হাট’ ও ‘শৃঙ্খল’। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘ফণীমনসা’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি।

প্রথম চলচ্চিত্র অভিনয় তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘সন্ত্রাস’সহ ফরীদি সর্বাধিক ২০টি ছবিতে অভিনয় করেন। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হচ্ছে ‘ভণ্ড’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামলছায়া’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ও ‘পালাবি কোথায়’