‘বৈষম্যের শিকার’ এক দলিত ছাত্রের আত্মহত্যা

ভারতের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত জনজাতিভুক্ত এক ছাত্র সোমবার বিকেলে আত্মহত্যা করেছেন।

গত বছর হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত শ্রেণীর এক গবেষক-ছাত্র রোহিত ভেমুলা ‘বৈষম্যে’র শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, যা নিয়ে সারা ভারতে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন তৈরি হয়েছিল।

২৭ বছর বয়সী মুথুকৃষ্ণন জীবানন্দম নামের ওই ছাত্র জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে পিএইচডি করতে ভর্তি হয়েছিলেন অনেকবারের চেষ্টায়।

যদিও দিল্লি পুলিশ তাঁর আত্মহত্যার জন্য ব্যক্তিগত কারণের-এর কথা বলছে। মুথুকৃষ্ণনের সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট এবং তাঁর বন্ধুদের কথায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে ‘দলিত’ হওয়ার কারণে ‘বৈষম্যে’র শিকার হচ্ছিলেন তিনি। তার ফলেই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।

তামিলনাডুর সালেম জেলার বাসিন্দা মুথুকৃষ্ণনের বাবা একটি বেসরকারী সংস্থায় পাহারা দেওয়ার কাজ করেন, মা দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে কাজ করেন।

প্রখ্যাত তামিল চলচ্চিত্রাভিনেতা রজনীকান্তকে নকল করতে পারেন বলে বন্ধুমহলে ‘রজনী-কৃষ’ নামে তিনি পরিচিত ছিলেন, ফেসবুক প্রোফাইলেও সেই নামই ব্যবহার করেছিলেন মুথুকৃষ্ণন।

ফেসবুকে সর্বশেষ যে পোস্ট করেছিলেন তিনি, তাতে লিখেছিলেন, “এম. ফিল/ পিএইচডি-তে ভর্তির ক্ষেত্রে সমানাধিকার নেই, মৌখিক পরীক্ষাতেও বৈষম্য। শুধুই সমতাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। প্রান্তিকদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অর্থ সব কিছু থেকেই বঞ্চিত করা।”

দিল্লি পুলিশের অতিরিক্ত সহকারী পুলিশ কমিশনার চিন্ময় বিশওয়াল বিবিসিকে জানিয়েছেন- “ওই ছাত্রের মৃতদেহ তার এক বন্ধুর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত হবে। কোনও সুইসাইড নোট আমরা পাইনি।”

“প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে কোনও ব্যক্তিগত কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ঘটনার সঙ্গে তাঁর মৃত্যুর যোগ রয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ এখনও পাই নি আমরা”- বলছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা চিন্ময় বিশওয়াল।

এদিকে মুথুকৃষ্ণনের বাবা জীবানন্দমও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তাঁর ছেলে আত্মহত্যা করতে পারেন।

বিবিসি তামিল বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জীবানন্দম জানিয়েছেন, “ওর খুব মনের জোর ছিল। দুদিন আগেও ফোন করে বলেছিল যে পরীক্ষা আছে সামনে। তারপরে বাড়ি আসবে। ও যে আত্মহত্যা করতে পারে, এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না।”

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি হায়দ্রাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, যেখানকার দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা নিয়ে গত বছর গোটা ভারতে ব্যাপক চর্চা আর ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

ফেসবুকেই তিনি একটি ধারাবাহিক গল্পও পোস্ট করছিলেন। এক দলিত শ্রেণীর ছাত্রের জীবনযুদ্ধ নিয়ে লেখা সেই গল্পটিতেও বারে বারে দলিতদের প্রতি বৈষম্যের কথা উঠে এসেছে। গল্পটিকে তাঁর নিজেরই জীবনযুদ্ধের কাহিনী বলে মনে করা হচ্ছে।

নিজে কী ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বারবার, তা লিখতে গিয়ে মুথুকৃষ্ণন জানিয়েছিলেন,“আমি চতুর্থবার জেএনইউতে এলাম। তিনবার এমএ-তে ভর্তির পরীক্ষা দিয়েছি। দুবার এমফিল আর পি এইচ ডি করার জন্য পরীক্ষা দিয়েছি, দুবার ইন্টাভিউ দিয়েছি।”

“প্রথমে ইংরেজী ঠিকমতো বলতে পারতাম না বলে ভর্তি হতে পারিনি। পরেরবার চেষ্টা করে ইংরেজী শিখে এসেছি। সবাই আমাকে ভরসা দিত এবার নিশ্চয়ই ভর্তি হতে পারবো। ছোটখাট কাজ করে পিঁপড়ের মতো পয়সা জমিয়েছি। ট্রেনে আসার সময়ে কোনও খাবার খাই নি।”

“একবার জেএনইউতে আসি আর নেহরুর মূর্তির নীচে বসে তাঁকে বলি আমার গোটা পরিবারতো কংগ্রেসকেই ভোট দেয়। কিন্তু আপনি কেন চান না যে আমিও শিক্ষিত হই!”- ফেসবুকে লিখেছিলেন মুথুকৃষ্ণন।

গত বছর জুলাই মাসে শেষমেশ ভর্তি হতে পেরেছিলেন তাঁর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু তাঁর বন্ধুরা বলছেন বারে বারে বৈষম্যের শিকার হয়ে মুথুকৃষ্ণন হতাশ হয়ে পড়ছিলেন।

দলিত সংগঠনগুলো বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্তের ফলে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলিত আর পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর পড়ুয়ারা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বারেবারেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আর তাই হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন রোহিত ভেমুলা বা মুথুকৃষ্ণন জীবানন্দমরা।