কুষ্টিয়ায় ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা উৎসব

ঢোল আর লাঠির তালে তালে নাচা নাচি। অন্য দিকে প্রতিপক্ষের হাত থেকে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনের প্রচেষ্টা সম্বলিত টান টান উত্তেজনার একটি খেলার নাম লাঠি খেলা। গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অংশ ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি এখনো বেশ জনপ্রিয়। আবহমানকাল ধরে নওগাঁসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলায় এক সময় বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে লাঠি খেলা। কিন্তু কালের বির্বতণে মানুষ আজ ভুলতে বসেছে এই খেলাটি।

লাঠি খেলা অনুশীলনকারীকে লাঠিয়াল বলা হয়। এই খেলার জন্য লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা, তবে প্রায় তৈলাক্ত হয়। প্রত্যেক খেলোয়ার তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করে।

কুষ্টিয়ায় ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা উৎসবআবারো অনেকদিন পর দেখা গেল লাঠি খেলা। কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ মাঠে শনিবার শুরু হয়েছে গ্রাম বাংলার প্রাচীণ ঐতিহ্য লাঠি খেলা উৎসব।

সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী এই লাঠি খেলায় প্রয়াত ওস্তাদ রতন চৌধুরীর কন্যা রুপন্তি চৌধুরী ও ওস্তাদ আলাল লাঠি খেলা প্রদর্শন করছেন। কুষ্টিয়া ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন জেলার ২৫টি দলে প্রায় ৫শ’ লাঠিয়াল এই উৎসবে অংশ নিয়েছে। এসব দলে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের সংখ্যাও কম নয়।

আর খেলা দেখতে অংশ নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। লাঠির ঠক ঠক আওয়াজ আর ঢোলের শব্দে পুরো এলাকা এখন উৎসবমুখর। আর একটু পরপর দর্শকদের মূহুর্মুহু করতালি ছাপিয়ে যায় সবকিছুকে।

‘বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী’ দুই দিনের এই উৎসবের আয়োজন করেছে। শনিবার বেলা ৩টায় কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. জহির রায়হান আনুষ্ঠানিকভাবে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন। এসময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নুল আবদিন, প্রবীন সাংবাদিক ওয়ালিউল বারী চৌধুরীসহ সরকারী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

কুষ্টিয়া ছাড়াও নড়াইল, ঝিনাইদহ, পাবনা, নাটোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ২৫টি দলের প্রায় ৫০০ লাঠিয়াল এই উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। এসব দলে পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি নারীদের সংখ্যাও কম নয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে মাঠে নামেন লাঠিয়ালরা। তারা কখনও ঢোল আর কাঁশরের তালে তালে নেচে নেচে তাদের কসরত দেখান, আবার কখনও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে লাঠি চালান। প্রতিপক্ষ লাঠিয়াল সেই আঘাত ঠেকিয়ে প্রতিঘাত করতে সদা প্রস্তুত বেতের তৈরী ঢাল আর লাঠি নিয়ে। আবার কেউ কেউ বন বন করে লাঠিয়ে ঘুরিয়ে দর্শকদের মন কাড়েন।

কুষ্টিয়ায় ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা উৎসবএবার নারী লাঠিয়ালরাও পুরুষ লাঠিয়ালদের কুপোকাত করছেন। দর্শকদের আনন্দে তখন যোগ হয় নতুন মাত্রা। লাঠিয়ালদের মধ্যে ১০/১২ বছরের শিশু থেকে রয়েছেন ৭০/৮০ বছরের বৃদ্ধও।

নড়াইল থেকে আসা লাঠিয়াল হায়াত আলী বলেন, এই লাঠি খেলা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। তার বাবা ও দাদা এক সময় লাঠি খেলতেন, সেই ঐতিহ্য তিনি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে পাবনার ঈশ্বরর্দীর লাঠিয়াল ইসমত আরা মনে করে, এটা নিছক একটি খেলা নয়। এর থেকে আত্মরক্ষার কৌশলও শেখা যায়।

বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন তাজু জানান, প্রাচীণকালে জমিদাররা শক্র দমনে লাঠিয়াল পুষতেন। জমিদারী প্রথা বিলোপের পর লাঠিয়ালদের প্রয়োজন ফুরালেও তাদের বংশধররা এটাকে খেলা হিসেবে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন।

তিনি বলেন, তার নানা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে ওস্তাদ ভাই লাঠিখেলা বাঁচিয়ে রাখতে ও সারা দেশের লাঠিয়ালদের সংগঠিত করতে একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরী করেন। তিনি ১৯৩৩ সালে কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী। আর্থিক দৈন্যতাসহ নানা কারণে লাঠিয়ালদের সেইভাবে সংগঠিত করা সম্ভব না হলেও তারা যথা সাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানান, আব্দুল্লাহ আল মামুন তাজু। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. জহির রায়হান বলেন, লাঠিখেলা দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। তবে আধুনিক খেলাধুলার ভীড়ে এই ঐতিহ্যবাহী খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে একে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।