জাতীয় সংসদ নির্বাচন: আলোচনা চায় জাতিসংঘ

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে চায় জাতিসংঘ। এ লক্ষ্যে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সময় চেয়েছে। সাক্ষাতের দিনক্ষণ নির্ধারণ হলে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তাদের পুরনো প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা করতে চায়। একই সঙ্গে তারা কারিগরি সহায়তা দেয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পরামর্শও নিতে চায়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া মিলছে না। তবে প্রতিনিধি দলটি আশাবাদী, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার জন্য তারা রাষ্ট্র্রপতির সময় পাবে। তখন রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা এতে অংশ নেবেন। এদিকে, মিয়ানমার সফরের পর রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ সফরে আসছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ দূত (র‌্যাপোটিয়ার) ইয়াং লি। রাখাইন কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসছে।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এবং আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনস বলেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা জানতে চাই। এর অংশ হিসেবে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে চাই। তিনি বলেন,সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। এটা ইতিবাচক দিক। প্রক্রিয়াটি সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। জাতিসংঘের এ আবাসিক সমন্বয়কারী বৃহস্পতিবার যুগান্তরসহ গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে এসব কথা বলেন।

রাষ্ট্রপতি যে সার্চ কমিটি গঠন করেছেন এ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাতিসংঘের সমন্বয়কারী বলেন, ‘আমরা জানি, রাষ্ট্রপতি সবচেয়ে কঠিন ও ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। এক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের নিয়োগ দেবেন। আমাদের এ কমিটি পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়নি। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর রাষ্ট্রপতি গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুরো বিষয়টি স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখছেন।’

গণতন্ত্র শক্তিশালী করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পুরনো প্রকল্পগুলোর চালিয়ে নেয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমাদের আলোচনার এটি অন্যতম একটি বিষয়। এগুলো বাংলাদেশের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় আমরা তার পরামর্শ নিতে চাই। কোথায় আমাদের কারিগরি সহায়তা প্রয়োজন সে বিষয়ে তার পরামর্শ চাই।’

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে ওয়াটকিনস বলেন, ‘এ মুহূর্তে তাদের সঙ্গে বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই। ভবিষ্যতে প্রক্রিয়াটি কিভাবে অগ্রসর হয় সেটা দেখার পর সিদ্ধান্ত নেব’।

জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আগেই ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃতে বিদেশী কূটনীতিকদের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাতের জন্য রাষ্ট্রপতির সময় চায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ আবেদন করা হয়। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে কূটনীতিকদের সময় পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে কূটনীতিকরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করতে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের নেতৃত্বে যে ক’জন বিদেশী কূটনীতিক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছেন তারা হলেন- মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদোন, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার নিব্লেট, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আলীসন ব্লেইক ও কানাডার হাইকমিশনার পিয়েরে লাঘামে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বুধবার এক ফেসবুক চ্যাটে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক করতে সহায়তা করতে চায়।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডিসেম্বরে ব্রাসেলসে এক বৈঠকে বলেছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে সক্ষম নির্বাচন কমিশন চায় ইইউ। এ প্রেক্ষাপটেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক চেয়েছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিদেশী কূটনীতিকদের বৈঠকের প্রয়োজন নেই। গোটা প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে বিদেশী কূটনীতিকরা এ সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কূটনীতিকদের জন্য একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করতে পারে।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি জানতে আসছেন ইয়াং লি : জাতিসংঘে মিয়ানমারে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ দূত ইয়াং লি মিয়ানমার সফরের পর এবার বাংলাদেশে আসছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের মানবিক দিক এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায় জাতিসংঘ। বিষয়টি সম্পর্কে বৃহস্পতিবার বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনস।

বৈঠকের পর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ওয়াটকিনস বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিভাবে কাজ করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে। তারা কক্সবাজার সফর করেছে। তারা তাদের রিপোর্ট জমা দেবে। কোনো এক সময়ে মিস লি বাংলাদেশ সফরে আসবেন। তিনিও কক্সবাজার সফরে যাবেন।’

রোহিঙ্গা বিষয়ে ওআইসি সম্মেলন সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতিসংঘের সমন্ব^য়কারী বলেন, ‘ওআইসির সঙ্গে আমাদের কিছু করার নেই। তারা নিজেদের উদ্যোগে সবকিছু করেছে। জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। কারণ মানবিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার পরিস্থিতি তদন্ত করা প্রয়োজন। তিনি (ইয়ং লি) মিয়ানমার সফর করেছেন। এখন তিনি বাংলাদেশ সফর করবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি বাংলাদেশে আসবেন। এ ব্যাপারে কোনো তারিখ নির্ধারিত হয়নি। ফেব্র“য়ারিতে এ সফর হতে পারে।’

কফি আনান কমিশন ঢাকায় আসছে : জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে এ প্রতিনিধি দল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য সফর করেছে। তবে বাংলাদেশ সফরে কফি আনান আসছেন না। তার কমিশনের প্রতিনিধিরা আসবেন। রাখাইন কমিশনের প্রতিনিধিরা কক্সবাজার সফরে যাবেন।

গত বছরের ৯ অক্টোবর সীমান্ত চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলায় মিয়ানমারের নয়জন ‘বর্ডার গার্ড পুলিশ’ (বিজিপি) নিহত হওয়ার জের ধরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। এই অভিযানে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের ফলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।