ইউক্রেন যুদ্ধে সমৃদ্ধ ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতি

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ২১টি দেশ ল্যাটিন অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণ আমেরিকার দশটি, মধ্য আমেরিকার ছয়টি, ক্যারিবীয় অঞ্চলের তিনটি ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের একটি দেশ রয়েছে এ অঞ্চলে। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে তখন থেকে শুধু এই দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপারটি এমন নয়। বিশ্ব বাজারে গম, তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম এখনও আকাশছোঁয়া, যার বেশিরভাগই উৎপাদন করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। ফলে এই দুটি দেশ থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে।

এই সংকটের বিপরীতে কয়েকজন বিশ্ব নেতা অবশ্য উজ্জ্বল দিক দেখছেন। গত মার্চ মাসে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো বলেছিলেন, ‘এই সংকট আমাদের জন্য একটি ভালো সুযোগ।’ একইভাবে গত মাসে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ বলেছিলেন যে তার দেশ ‘বিশ্বের এখন যা প্রয়োজন তার একটি আধার, বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানির’।

ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতি প্রকৃতপক্ষে অন্য অনেক উঠতি বাজারের তুলনায় যুদ্ধকে ভালোভাবেই মোকাবিলা করছে। কিন্তু এই অঞ্চলজুড়ে বসবাস করা মানুষগুলোর পরিবার যুদ্ধ-প্ররোচিত মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এটি অর্থনীতিতে দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে এবং মধ্যম মেয়াদে, কিছু ল্যাটিন আমেরিকান দেশের অর্থনীতি ঝড়ের মুখে পড়তে পারে।

যুদ্ধের আগে, ২০২২ সালে উদীয়মান বিশ্ব অর্থনৈতিক অস্বস্তিতে পড়েছিল। বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশের অর্থনীতিতে প্রাক-মহামারি প্রবণতার ফলাফল কম ছিল এবং ঋণের বোঝা যথেষ্ট বেশি ছিল। সরবরাহ-শৃঙ্খলে জটিলতা ও ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধি গৃহস্থালির পণ্য ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ধনী দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সুদের হার দরিদ্র দেশগুলোর মূলধনকে টেনে ধরছে। আর্থিক চাপ বাড়ছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর।

ল্যাটিন আমেরিকাকেও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে অস্থির অবস্থানে মনে হচ্ছিল। গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করেছিল, ২০২২ সালে এই অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে সর্বনিম্ন হবে। এরই মধ্যে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে যে, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো গত তিন মাসে বেশ ভালো করেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গম ও তেলের দাম ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে এসব দেশে।

আর্জেন্টিনার জন্য এটি সুসংবাদ। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পরে আমেরিকায় তৃতীয় বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ এটি। তেল ও গ্যাসের বাড়তি দাম হাইড্রোকার্বন রপ্তানিকারকদের যেমন, ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার জন্য আশা জাগাচ্ছে। যদিও বেশিরভাগ দেশের জন্য সম্ভাবনা ম্লান হয়ে গেছে, তবে আইএমএফ এ বছর আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পেরু ও কলম্বিয়ার জন্য তাদের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সংশোধন করেছে।

উদীয়মান বিশ্বের অন্যত্র খাদ্য ও জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যয় একটি কঠিন সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করার জন্য হুমকিস্বরুপ। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কায় তেল আমদানির ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে রিজার্ভ কমে গত এপ্রিলে সরকারকে ঋণ খেলাপি হতে বাধ্য করে।

ল্যাটিন আমেরিকার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে, এর বিপরীতে দামি বিদেশি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি স্থির প্রবাহ প্রদান করেছে, যা সেখানকার মানুষ ও কোম্পানিগুলোকে ভালো শর্তে আমদানি করতে সক্ষম করে তোলে। এই অঞ্চলের অনেক দেশে মুদ্রা ডলারের বিপরীতে মূল্য অর্জন করেছে, যা বাকি উদীয়মান বিশ্বের অনেকের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

উচ্চ খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যের যন্ত্রণা থেকে ভোটারদের রক্ষা করার চেষ্টায় এটি রাজনীতিবিদদের জন্য খুব ভালো খবর। যা অন্য অনেক দেশই বহন করতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ, পাকিস্তান সরকার শ্রীলঙ্কার মতো পরিণতি এড়াতে মরিয়া ঋণ দরখাস্তে জ্বালানি ভর্তুকি কমিয়ে দিচ্ছে। মেক্সিকোতে এর বিপরীতে, তেল রপ্তানি থেকে অর্জিত অর্থের উল্লম্ফন অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ভর্তুকির বর্ধিত ব্যয় কমাতে সহায়তা করেছে। কলম্বিয়া ও চিলির সরকার ভর্তুকি বজায় রাখছে, যখন পেরুতে সরকার খাদ্য ও জ্বালানির ওপর ট্যাক্স কমিয়েছে।

বিষয়টি গোলাপের মতো শুভ্র নয়। এমনকি সংশোধনের পরেও, আইএমএফ পূর্ব ইউরোপ ব্যতীত উদীয়মান বিশ্বের অন্যান্য অংশের তুলনায় এ বছর ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতি ধীরে ধীরে এগোবে বলে আশা করছে।

পণ্যের উচ্চ মূল্য থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিল সম্ভবত এ বছর প্রবৃদ্ধি বাড়ার চেষ্টা করবে। ব্যয়বহুল খাদ্য ও জ্বালানি রপ্তানিকারকদের জন্য সহায়ক হলেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে দেশটিতে। চিলি ও ব্রাজিলে ভোক্তা মূল্য সূচক অংকের হারে দ্বিগুণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াচ্ছে। ফলে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যেটি বিনিয়োগ ও উৎপাদনেও প্রভাব ফেলবে।

অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে যদি ধনী দেশগুলোর অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি স্থায়ী প্রমাণিত হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে বাজারের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হারে সুদ বাড়াতে বাধ্য করে। ১৯৮০-র দশকে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুতর মুদ্রাস্ফীতি সমস্যাকে রোধ করার চেষ্টা করছিল, তখন ল্যাটিন আমেরিকার পরিণতি ছিল ভয়াবহ। ঋণ সংকটের ঢেউ এবং হারানো অর্থনীতির দশক ছিল সেটি। তখন থেকে সমগ্র আমেরিকাজুড়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু একাধিক ধাক্কার সম্মিলিত চাপ আজ অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।

এই অঞ্চলটি আরেকটি সংকট সহ্য করতে পারবে না। ল্যাটিন আমেরিকা ২০২০ সালে বিশ্বের অন্য যে কোনো অংশের তুলনায় জিডিপিতে একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। করোনা মহামারিতে বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় এবং উৎপাদন হ্রাস পায়। প্রকৃতপক্ষে, আইএমএফ মনে করে যে ২০২৪ সালে ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে ফলাফল প্রাক-মহামারি জিডিপির প্রবণতার প্রায় ৫ শতাংশ কম থাকবে।

চরম আর্থিক ভারসাম্যহীনতায় জর্জরিত দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেড়ে যেতে পারে। কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের নির্বাচনের পূর্বাভাস দেখে মনে হচ্ছে যে এখনো তারা অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। পণ্যের দাম বেশি হোক বা না হোক সমগ্র অঞ্চলে হতাশা বাড়বে যদি সরকারগুলো সরবরাহ শৃঙ্খল বা ত্রাণ তৎপরতা ঠিক রাখতে না পারে। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

বিডিসংবাদ/এএইচএস