অনিশ্চতায় রাহুলের রাজনৈতিক জীবন

ভারতের রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি। ৪০৩ আসনের মধ্যে বিজেপি জোট পেয়েছে ৩২৫টি। উত্তরাখণ্ড রাজ্যেও বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তবে পাঞ্জাবে জয় পেয়েছে কংগ্রেস। গোয়া ও মনিপুর রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বেশি আসন পেয়েছে কংগ্রেস তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি তারা। গত শনিবার এই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল উত্তর প্রদেশ রাজ্যের নির্বাচনকে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের জন্য বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছিলো। কারণ গত বছরের নভেম্বরে পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট বাতিলের পর সারা দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়েছিলো, এবারের পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে। আর ভরাডুবি হতে পারে বিজেপির। কিন্তু তা হয়নি বরং উত্তর প্রদেশে অভাবনীয় এক জয়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছেন মোদী।

উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সংসদীয় রাজনীতিতেও বিজেপি-কে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছে। সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিজেপি এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নয়। তাই মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের আনা অনেক বিলই সেখানে আটকে যায়। কিন্তু রাজ্য বিধানসভাগুলিতে নবনির্বাচিত বিজেপি সদস্যদের ভোটে যতজন সংসদ সদস্য রাজ্যসভায় পাঠাতে সক্ষম হবে বিজেপি, তার ফলে উচ্চকক্ষের সেই সংখ্যার ভারসাম্য বিজেপির অনুকূলে অনেকটাই চলে যাবে।

এই রাজ্যে বিদায়ী সরকার সমাজবাদী পার্টি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটে নেমেছিল। তারা মুখ থুবড়ে পড়েছে। জোটের প্রচারে প্রধান মুখ ছিলেন দুই দলের দুই যুব নেতা বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব ও কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী। আর বিজেপির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে ব্যাপক প্রচারাভিযানে নেমেছিলেন। মোদী যেমন তাঁর উন্নয়নের এজেন্ডা নিয়েই এগিয়েছিলেন প্রচারে, তেমনই রাজ্য সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন।

নিরঙ্কুশ জয়ের মাধ্যমে ১৫ বছর পর আবার বিজেপি উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় এসেছে। বলা হচ্ছে, এই জয় নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথকে সুগম করবে। ইতোমধ্যে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ্ দাবি করেছেন, ভারতের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা নরেন্দ্র মোদী।

আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গণতান্ত্রিক মাপকাঠিতে পাঁচটি রাজ্যের ফলাফলই সমান তাত্পর্যের। কিন্তু রাজনৈতিক মাপকাঠিতে উত্তরপ্রদেশের লড়াইটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় রাজনীতির প্রাচীন ও পরিচিত প্রবাদ বলে, দিল্লি পৌঁছনোর সব রাস্তা উত্তরপ্রদেশ হয়েই যায়। গোটা দেশের দৃষ্টি তাই নিবদ্ধ ছিলো উত্তরপ্রদেশের দিকেই। উত্তর প্রদেশের ফল দিল্লির মসনদে নরেন্দ্র মোদীর কর্তৃত্ব পোক্ত করেছে।

নির্বাচনের ফল বলছে, মোদীর নোট বাতিলে আস্থাই রেখেছেন গরিব মানুষ। গত ১৫ দিনে দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচনের ফল প্রকাশ্যে এসেছে। মহারাষ্ট্রে বৃহত্ মুম্বাইসহ ১০টি পুরসভায় নির্বাচন, গ্রামীণ ওডিশায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর শনিবার উত্তরপ্রদেশসহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ফল জানা গেছে। প্রায় সর্বত্রই বিজেপির  রমরমা। তাই বলা যায়, নোট বাতিলের কোনো প্রভাবই ইভিএমে পড়েনি।

আনন্দবাজার পত্রিকার আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশের ভোটে বিজেপির বিপুল জয় আসলে নরেন্দ্র মোদীর জয়। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী পদে কোনো প্রার্থী ছিলেন না। মূল লড়াইটা ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের। মায়াবতী ব্যঙ্গ করে এ কথাও বলেছিলেন যে, নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করছেন। ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, সবাই ধরাশায়ী হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে, অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহ, এমনকি আরএসএস-এর বহু নেতা বিজেপি জিতবে এমনটা আশা করলেও এ রকম ঝড় হবে সেটা ভাবেননি। কোনো বুথ ফেরত জরিপে বিজেপিকে এত আসন দিতে রাজি হয়নি।

তবে এই বিপুল বিজয়ে মোদীত্বের যে জয় হল, তাতে তাঁর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব দল ও সরকারের মধ্যে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হল। এর ফলে আগামী দিনে বিজেপি রাজ্যসভায় তার আসল সংখ্যার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পেল। আগামী জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজস্ব দলীয় প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ পেল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর দল উত্তরপ্রদেশে একটিও মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। অথচ বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বিজেপি জিতেছে। অতএব নরেন্দ্র মোদী এখন ভারতের রাজনীতিতে এক অবতার।

অন্যদিকে, কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীর জন্য ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনের ফলাফল। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী অসুস্থতার কারণে নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে চান। কিন্তু তাঁর বিকল্প হিসেবে রাহুল কি আদৌ প্রস্তুত কিনা? এই প্রশ্ন রয়েছে ঘরে-বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশসহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে প্রথমবার রাহুল একা সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিলেন দলকে। ফল ভাল হলে, রাহুল গান্ধীর আগামী যাত্রাপথ অনেকটাই কুসুমাস্তীর্ণ হয়ে উঠতো। কিন্তু বিপর্যয়ের মুখ দেখায় আরও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে কংগ্রেস সহ-সভাপতির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

সূত্র: যুগান্তর, তালেব।