অধিক চাষাবাদের চাপে ঝুঁকিতে মাটির স্বাস্থ্য

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

যমুনা নদী বিধৌত টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা। এই জেলার দায়িত্বে থাকা মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা উৎপল কুমার বলছেন, আগে এই উপজেলার যেসব জমিতে সরিষা, বোরো ও আমন এই তিন ফসল হতো। এমন অনেক জমিতে এখন শুধু বোরো বা এক ফসল হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, আমরা গবেষণা করে দেখেছি, এই এলাকায় প্রচুর ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটা এলাকার জমিগুলো আগে মাঝারি উঁচু ছিল। ফলে তিন ফসল হতো। টপ সয়েল বা মাটির উপরিভাগ কেটে ইটভাটায় দেয়ায় সেই জমি এখন মাঝারি নিচুতে পরিণত হয়েছে। জমি নিচু হয়ে পড়ায় ফসল তলিয়ে যায়। নাগরপুরের মতো বাংলাদেশের প্রায় সব উপজেলার অবস্থা এমনই। শুধু যে ইটভাটার কারণে মাটির উপরিভাগ তথা টপ সয়েল সরানো হচ্ছে তা নয়। ফসলি জমির টপ সয়েল ব্যবহার হচ্ছে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর নির্মাণেও। মাটির গুণাবলি সম্পন্ন উপাদান নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ দিকে অধিক লাভের আশায় তিন ফসলি জমি খনন করে পুকুর কাটার হার দিন দিন বাড়ছে। এটা কোনোভাবেই থামাতে পারছে না স্থানীয় কৃষি ও ভূমি অফিস। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপের কাছে হার মানছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের চোখের সামনেই ফসলি জমি দেদার পুকুর হচ্ছে। ভেকু মেশিন দিয়ে ফসলি জমির টপ সয়েল ইটভাটায় নেয়া হচ্ছে।

এমন এক প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। মৃত্তিকা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘মাটি : খাদ্যের সূচনা যেখানে’। এ উপলক্ষে আজ সকালে কেআইবি মিলনায়তনে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এতে প্রধান অতিথি থাকবেন।

কৃষি ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা বিশ্বই খাদ্য ঝুঁকিতে। বিশেষ করে বাংলাদেশে আগামী বছর খাদ্যের চরম সঙ্কট দেখা দিতে পারে- এমন আশঙ্কা বিভিন্ন মহলের। কৃষি বিভাগ বলছে, প্রতি বছর ০.৭২ শতাংশ হারে কৃষি জমি কমছে। শিল্প কারখানা, বাড়িঘর ও রাস্তা নির্মাণ, পুকুর খনন, নদীতে বিলীন হওয়াসহ নানা কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। অথচ প্রতি বছরই দেশে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ক্রমাগতভাবে ধানসহ নানা রকম ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। বছরে দুই-তিন ফসল ফলাতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষক। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের প্রসার ঘটছে দেশে। মূলত দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনুপাতে ফসল ফলাতে সরকার স্বল্প জমিতে অধিক ফসলে গুরুত্ব দিচ্ছে। যেসব জমিতে এক ফসল হয় সেসব জমিতে দুই বা তিন ফসল ফলাতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করছে। কিন্তু অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে জমির পুষ্টি ও উর্বরতা দিন দিন কমে আসছে। গবেষকরা বলছেন, একই জমিতে অধিক ফসল ফলানোতে খাদ্যনিরাপত্তা হয়তো নিশ্চিত হতে পারে বটে, কিন্তু মাটির জৈব উপাদান আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। এর ফলে মাটির উর্বরতা যেমন কমছে তেমনি ক্রমাগতভাবে মাটির উর্বরতা ঝুঁকি বাড়ছে। অধিক ফসল ফলাতে গিয়ে মাটির স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।

২০২০ সালে এসআরডিআই ‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে সব ধরনের বিশেষ করে আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে জমির পরিমাণ এক কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে এক কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা মোট জমির প্রায় ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশে।

এসআরডিআইর মহাপরিচালক মো: কামরুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, মাটির অতি ব্যবহার হচ্ছে এখন। অতি ব্যবহার কোনো কিছুতেই ভালো না। বছরের অধিকাংশ সময়ই আমাদের জমি চাষাবাদের মধ্যে রাখছি। এতে মাটির গুণাগুণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। মাটিতে যেসব খাদ্য গাছের জন্য জমা থাকে তার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। মাটিতে গাছের জন্য ১৩টি খাবার থাকে, তার অর্ধেকেরও বেশি মাটিতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। সার প্রয়োগ করে সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আরো কিছু খাবার মাটিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এসব দিক অবলোকন করলে বুঝা যায় মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। এই মৃত্তিকা বিজ্ঞানী বলেন, আমাদের মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ কাক্সিক্ষত মাত্রার চেয়ে অনেক কম। ভালো মাটিতে ৪-৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার কথা। এর বিপরীতে কোথাও এক ভাগের কিছু বেশি, কোথাও এর চেয়ে কম আছে বর্তমানে।

উত্তরণের পথ : মো: কামরুজ্জামান বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে চাষাবাদ করতে হবে আমাদের। বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে ফসল বিন্যাস যেমন- এ বছর এক ফসল, সামনের বছর আরেক ফসল করতে হবে। জমিতে নাড়া/খড় সবটুকু তুলে না নিয়ে এসে অন্তত ৪০ ভাগ ক্ষেতে রেখে আসতে হবে। প্রতি বছর কিছু না কিছু জৈব পদার্থ মাটিতে দিতে হবে। মাটির তিনটি গুণাবলির কথা উল্লেখ করে এই মৃত্তিকা বিজ্ঞানী বলেন, প্রথমটা হচ্ছে রাসায়নিক গুণাবলি। মাটি অতি ব্যবহারের কারণে প্রত্যেকটা ফসল যখন আমরা মাঠ থেকে কেটে নিয়ে আসি, তখন শুধু আমরা ফসলই আনি না। সাথে সাথে মাটিতে যেসব খাবার আছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশও নিয়ে আসি। এই যে ফসলের সাথে মাটির খাদ্য উপাদান নিয়ে আসছি, সেই পরিমাণ উপাদান যদি প্রতি ফসল তোলার পর পর উপযুক্ত পরিমাণে মাটিকে ফেরত না দেই তাহলে এটা বছরের পর বছর ঘাটতি থেকে যাবে। এক সময় মাটির রাসায়নিক গুণাবলির দিক থেকে স্বাস্থ্যহানি ঘটবে।

দ্বিতীয়ত : মাটিতে অধিক ফসল চাষাবাদের কারণে মাটির যেসব ভৌত গুণাবলী বা যেসব ছিদ্র আছে, যেখান দিয়ে বাতাস চলাচল করে। ছিদ্রের ভেতর পানি থাকে। অধিক চাষাবাদের ফলে এসব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির আরেকটি গুণাবলি হলো জৈবিক বা জৈব গুণাবলী। সেটা হলো-মাটির ভেতরে কোটি কোটি ব্যাক্টেরিয়া, অণুজীব থাকে। জমিতে সারা বছর অধিক চাষাবাদের ফলে এসব অণুজীবগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এদের বংশবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাটিতে অণুজীবের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই অণুজীব আমাদের জন্য খুবই উপকারী। এটা মাটিতে কার্বন যুক্ত করে।

তিনি বলেন, মাটির উপরি অংশ বা টপ সয়েল হচ্ছে সবচেয়ে গুণাবলি সম্পন্ন মাটি। হাজার হাজার বছর ধরে এই মাটির স্তর দাঁড়িয়েছে। এই মাটি কেটে নিয়ে যাওয়াটা একেবারেই অন্যায়, ক্ষতিকর। মাটির উপরের যে অংশটা থাকে সেটায় জৈবপদার্থ থাকে। গাছের অনেক খাবার থাকে। এই মাটি ইটভাটা বা রাস্তার জন্য কেটে নষ্ট করাটা নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো অবস্থা। এটা খুবই অবৈজ্ঞানিক কাজ। এটা দমন বা রহিত করা খুবই জরুরি।

এসআরডিআইর পরিচালক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেন বলেন, জনসংখ্যার চাপের কারণে একই জমিতে একাধিক ফসল করতে হচ্ছে আমাদের। জমি থেকে যে পরিমাণ ফসল নিচ্ছি, সেই পরিমাণ জৈব পদার্থ যুক্ত করতে পারছি না। ফলে মাটির জৈব পদার্থ শুধু না, অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও কমে যাচ্ছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে আদর্শ মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার কথা। আর বাকি ৪৫ শতাংশই অর্গানিক ম্যাটারিয়াল, ২৫ শতাংশ পানি এবং ২৫ শতাংশ বাতাস থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতে গড়ে অর্গানিক ম্যাটার বা জৈব পদার্থ ১ শতাংশেরও কমে চলে আসছে। ফলে দেশে মাটির উর্বরতা অনেক ঝুঁকিতে আছে। যার ফলে ক্রমাগতভাবে রাসায়নিক সারের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তাহসিনা শারমিন হক বলেন, শুধু রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল উৎপাদন বাড়ানো গেলেও একটা সময়ে গিয়ে মাটির উর্বরতার ক্ষতির কারণ হবে এটি। এই বিজ্ঞানী বলেন, আমাদের ব্যালান্স ফার্টিলাইজারেশন করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে চাহিদা অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে (রাসায়নিক ও জৈবসার)।

জনবলের অভাব : দেশের মোট ৬৪ জেলার মধ্যে বর্তমানে ৪১ জেলায় এসআরডিআইর কার্যালয় আছে। বাকি জেলায় এসব অফিসের কর্মকর্তারাই দেখভাল করেন। ২০১৯ সালের আগে বৃহত্তর ২০ জেলায় কার্যক্রম ছিল। একটা অফিসে একজন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ চারজন অফিসার থাকার কথা থাকলেও বেশিরভাগ জেলাতেই রয়েছেন মাত্র একজন। একইভাবে কর্মচারী সঙ্কটও রয়েছে। তবে গতকালই ৪০তম বিসিএসের ২৩ জন মৃত্তিকা ক্যাডার যোগদান করেছেন বলে জানা যায়। বাকি জনবলও আস্তে আস্তে পূরণ হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বিডিসংবাদ/এএইচএস