একটি নক্ষত্রের বিদায়

গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্বরণে

একটি নক্ষত্রের বিদায়-গাজী মাজাহারুল আনোয়ার স্বরনে

লেখকঃ হাসিনা মরিয়ম

তারিখটা ১৯৪৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী, কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম গ্রাম তালেশ্বর ( মিয়া বাড়ী) তে এই নক্ষত্রের জন্ম।

বাবা মার প্রথম সন্তান, সবার মুখে হাসি, সবার ভালোবাসা আর মমতায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেন তিনি। পড়াশুনা শুরু করেন কুমিল্লা জিলা স্কুলে। তারপর স্কুল কলেজের পাঠ চুকিয়ে ষাটের দশকের শুরুতে ভর্তি হন চিকিৎসা বিজ্ঞানে, কিন্তু শেষ অবদি মেডিকেল  পাঠ চুকাতে পারেননি, উনার নেশা যে লেখালেখিতে।

স্কুলের পড়ার সময় থেকেই তিনি দেয়াল পত্রিকায় কবিতা লিখতেন ,তারপর  খুব নাটকীয়ভাবে গান লেখা শুরু করলেন, মেডিকেলে পড়ার সময় সেখানে একটা নাটক হওয়ার কথা এবং সেটাতে একটা গানের প্রয়োজন ছিল, গানটা তখনকার প্রখ্যাত আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যার এর লেখার কথা ছিল কিন্তু সময় স্বল্পতার কারনে গানটা উনার লেখা হয়ে উঠেনি। সেই সময় নাটকের পরিচালককে তিনি গানটা লিখে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন এবং লিখলেন। পরবর্তীতে সেই গানটা গেয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ফরিদা পারভীন। সেই ভাবেই উনার রেডিওতে গানের রচয়িতা হিসেবে অভিষেক, পরবর্তীতে উনাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

একের পর এক কালজয়ী সব গান উপহার দিয়েছেন এই দেশকে এবং দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে ও মানুষের কাছে এক নন্দিত নাম  গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর কাল জয়ী সব গান দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি। বিবিসি বাংলায় ২০০৬ সালে শ্রোতাতের মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় বিশটি গানের মধ্যে ছিল তাঁর রচিত তিনটি গান, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’। বিশ হাজারেরও বেশী গান লিখেছেন বাংলার এই নক্ষত্র। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানের ভাণ্ডারকে, কালজয়ী সব দেশাত্ববোধক গান লিখেছেন  তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের ও এদেশের আপামর জনসাধারনকে উজ্জিবীত করে রেখেছিল, যে গানটি এখন ও মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ যেই দিনগুলি বছরের নানা সময় উদযাপন করা হয়,সে সময় সারা দেশজুড়ে বাজানো হয় তারই লেখা বিখ্যাত সেই কালজয়ী গান “জয় বাংলা বাংলার জয়” পাঁচ দশকের বেশী সময় ধরে তাঁর গানে উঠে এসেছে দেশপ্রেম, বাংলার মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের জীবনের গল্প, প্রেম-বিরহ ও আধ্যাত্মিক গান। উনার লেখা গান গেয়ে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন শিল্পী সঙ্গীতের ক্যারিয়ারে সফলতা পেয়েছেন। তাঁর জনপ্রিয় অনেক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন অনেক বিখ্যাত শিল্পীগন, এই গুনী মানুষটিকে এই দেশ ও মাটি দুই হাত উজার করে দিয়েছে। মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা ছাড়াও কাজের মূল্যায়ন হিসেবে পেয়েছেন অগনিত পুরষ্কার ।

দুর্দান্ত প্রতাপে গান লেখা ছাড়াও দীর্ঘ ৬০ বছরের ক্যারিয়ারে বানিয়েছেন মাটি ও মানুষকে নিয়ে চলচ্চিত্র, পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন অনেক ছবি,তিনি একজন সফল কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার হিসেবে পেয়েছেন ৬ বার জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার। এছাড়াও ২০০২ সালে একুশে পদক, ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণ পদক,২০২১ সালে স্বাধীনতা পদক, এস এম সুলতান স্মৃতি সম্মাননা পদক, একাধিকবার বাচসাস পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন এই কিংবদন্তী সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব।

গত ৪ সেপ্টেম্বর রবিবার না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন কালজয়ী এই গুনী মানুষটি। রেখে গেছেন বিখ্যাত সব সৃষ্টি। হঠাৎ সকালে অসুস্থবোধ করলে উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যু কালে উনার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

রাষ্ট্রপতি উনার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে এক শোক বার্তায় বলেছেন, “গাজী মাজহারুল আনোয়ার তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন দেশের সংস্কৃতিকে। তাঁর মৃত্যু সাংস্কৃতিক অঙ্গনের  এক অপূরনীয় ক্ষতি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরেণ্য এই গীতিকারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এক শোক বার্তায় তিনি বলেছেন, বিখ্যাত এই গীতিকার তাঁর কালজয়ী সৃষ্টির মাধ্যমে এদেশের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন।

শোক জানিয়েছেন বি এন পির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এক শোক বার্তায় তিনি বলেছেন, “আমরা কিংবদন্তি মেধাবী ও সৃজনশীল একজন মানুষকে হারালাম”

সময়ের তাগিদে গান লেখা শুরু করেছিলেন, সময়টা ছিল সংগ্রামের,অধিকার আদায়ে কৃষক-শ্রমিক ছাত্র যে যার মত আন্দোলন করছে।  তিনিও আন্দোলনে নামার তাগিদ অনুভব করলেন, কলমটাকে মাধ্যম করে জড়িয়ে গেলেন আন্দোলনে লিখে ফেললেন সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, প্রথম দিকে এই গানটি মুক্তিযুদ্ধের থিম গানে পরিণত হলো। তখনকার সময় স্বাধীন বাংলা বেতারের অধিবেশন শুরু হতো এই গান দিয়ে,শেষ হতো এই গান দিয়ে, চারিদিকে যুদ্ধ,সারাদিন প্রায় বাজতো এই বিখ্যাত গান। তবে কঠিন শব্দ বসিয়ে গান লেখার পক্ষে ছিলেন না তিনি। তাঁর কাছে মনে হত গান হতে হবে সার্বজনীন , যারা শুনবে সহজেই যেন তা বুঝতে পারে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়া হয় উনাকে, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর উনার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল( বিএফডিসি )তে নেয়া হয় ,এখানে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

তিনি বলেন,  গাজী মাজহারুল আনোয়ার তাঁর কালজয়ী সৃষ্টির মাঝে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।

মন্ত্রী বলেন,  বিএফডিসি নতুন ভবনে একটি জায়গা রয়েছে, সেখানে দেশের গুণী শিল্পী,গীতিকার, সুরকারদের সৃষ্টকর্ম সংরক্ষণ করা হবে।  সেখানে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সৃষ্টিও সংরক্ষন করা হবে। 

এদেশের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত এই প্রবাদপুরুষ মায়ের কবরে শায়িত হয়েছেন। স্ত্রী ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন ও বহু গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।  আর একজন গাজী মাজহারুল আনোয়ার এই দেশের মাটিতে জন্ম নিবেন কিনা জানিনা তবে  দেশ হারালো তার অমূল্য সম্পদ।

মানুষের ভালবাসায় সিক্ত এই গুণী মানুষটি গান প্রিয় মানুষদের মাঝে বেঁচে থাকবেন দীর্ঘকাল।

হাসিনা মরিয়ম (কবি,সাহিত্যিক ও সাংবাদিক)