ভারতে এবার গরুর গোশত বহন করে গণপিটুনির শিকার দুই দলিত

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

ভারতের মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্য ছত্তিশগড়ের পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকালে দুই ব্যক্তিকে অন্তর্বাস পরা এবং আহত অবস্থায় কিছু সাধারণ মানুষ বিলাসপুর জেলার একটি থানায় নিয়ে আসে।

স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ ছিল, ওই দু’জন বস্তায় ভরে গরুর গোশত নিয়ে যাচ্ছিলেন।

ওই গোশত সরকারি পশু চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখা যায় যে তা গরুর গোশতই ছিল।

অন্য আরো অনেক ভারতীয় রাজ্যের মতো ছত্তিশগড়েও গরুর গোশত নিষিদ্ধ।

ধৃতরা দলিত, চামড়ার কাজে যুক্ত
যে দু’জনের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা গরুর গোশত বহনের অভিযোগ করেছিলেন, তাদেরকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

ওই দু’জনের নাম নরসিং রোহিদাস ও রামনিবাস মেহর। এরা দলিত শ্রেণীভুক্ত এবং দু’জনেই চামড়ার কাজের সাথে যুক্ত।

ঘটনার পরে পুলিশ যে সংবাদ বিবৃতি জারি করেছে, তাতে লেখা আছে, রেললাইনে কাটা পরা একটি বাছুরের চামড়া তাদের কাজে লাগানোর জন্য বস্তায় ভরে নিয়ে যাচ্ছিলেন ওই দুই ব্যক্তি।

সামাজিক মাধ্যমে গণপিটুনির ভিডিও
কিন্তু এর এক দিন পরে, বুধবার সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে ধৃত দু’জনকে গণপিটুনির শিকার হতে দেখা যায়।

একটি মোটরসাইকেল নিয়ে তারা যখন অন্তর্বাস পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে ভিডিওটিতে।

এই দৃশ্য অনেক মানুষ ভিডিও করছিল আর একজনকে দেখা যায় রোহিদাস আর মেহরের বেল্ট দিয়ে পিঠে মারছে।

‘গণপিটুনিতে যুক্তদেরও ছাড়া হবে না’
বিলাসপুর পুলিশের আইজি রতনলাল ডাঙ্গি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, মূল ঘটনার এক দিন পরে সামাজিক মাধ্যমের সূত্রে ভিডিওটি তাদের হাতে আসে।

‘গ্রেফতার হওয়া দু’জনকে যে ব্যক্তি বেল্ট দিয়ে মারছিলেন, তাকে চিহ্নিতও করতে পেরেছি আমরা। এফআইআর তার নামেও করা হয়েছে, কিন্তু ঘটনার দিন থেকেই সে পলাতক। তার খোঁজে তল্লাশি চলছে,’ জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, যারা আইন ভেঙে গরুর গোশত বহন করছিল, তাদের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, একইভাবে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে যারা ওই দুজনকে মেরেছেন, তাদেরও শাস্তি পেতে হবে।

গণপিটুনির পরে পুলিশ যে বিবৃতি দিয়েছিল, সেখানে উল্লেখ করা আছে যে জনা পঞ্চাশেক মানুষের একটি দল অর্ধনগ্ন ও আহত অবস্থায় রোহিদাস ও মেহরকে থানায় নিয়ে এসেছিলেন।

গণপিটুনি যারা দিয়েছিলেন, তাদের সেখানেই কেন আটক করা হলো না, এখন এই প্রশ্ন তুলেছে ছত্তিশগড়ের দলিত সমাজ।

ক্ষুব্ধ দলিত সমাজ
রাজ্যের বেশিরভাগ দলিত যে সতনামী সম্প্রদায়ের, তাদেরই সংগঠন গুরু ঘাঁসিদাস সেবাদার সংঘের আইনি উপদেষ্টা প্রিয়াঙ্কা শুক্লা বলেন, ‘ভিডিওতে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে কারা মারছিল সেদিন। একজন অন্যায় করেছে, কিন্তু তার ওপরে হাত ওঠানোর, তাকে মারার অধিকার তো কারো নেই!’

‘পুলিশ সেদিন কী করছিল?’- প্রশ্ন তোলেন শুক্লা।

‘ওই ভিড় যখন থানায় গিয়েছিল তখনই তাদেরও আটক করা হলো না কেন! আর পুলিশ যদি একজনের নামে এফআইআর করে থাকে আর বলে যে সে পলাতক, এটা তো পুলিশের ব্যর্থতা! সরকার কিন্তু এ নিয়ে এখনো মুখ খোলেনি।

‘দলিত সমাজে এটা নিয়ে সঙ্গত কারণেই ক্ষোভ জন্মিয়েছে,’ বলছিলেন শুক্লা।

তিনি জানান, ছত্তিশগড়ে সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনা যখনই হচ্ছে, তখনই সরকার কঠোর আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু কিছুই করেনি তারা।

গরুর গোশত, গরু পরিবহনের ওপরে নজরদারি
গত কয়েক বছরে ভারতে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ গরুর গোশত বা গরু পরিবহন করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন, আর আহত হয়েছেন আরো অনেকে।

হিন্দুদের কাছে পবিত্র এই পশু বেআইনিভাবে পাচার করা হচ্ছে কী না, বা কেউ জবাই করার জন্য গরু নিয়ে যাচ্ছে কী না, তার ওপরে নজরদারি চালাতে উত্তর, মধ্য আর পশ্চিম ভারত জুড়ে বেশ কয়েকবছর ধরেই তৈরি হয়েছে নজরদার বাহিনী।

এসব বাহিনীর সদস্যরা কোনো না কোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত।

এরা লাঠি, রড, ধারালো অস্ত্র নিয়ে রাত পাহারা দেয় সড়ক, মহাসড়কগুলোতে। নজর চলতে থাকে ট্রাক, বাস আর রেলস্টেশনেও।

মুসলমানদের পরে গরুর গোশতের সহিংসতায় টার্গেট দলিতরা?
গরুর গোশত সংক্রান্ত যতগুলো গণপিটুনির ঘটনা হয়েছে, তাতে জড়িত থেকেছে এসব নজরদার বাহিনীগুলোই।

প্রায় সাত বছর ধরে লাগাতার এ ধরনের গণপিটুনির খবর আসছিল, কিন্তু করোনাভাইরাস লকডাউনের সময় থেকে গণপিটুনির ঘটনা কমে এলেও একেবারে থেমে যায়নি।

‘অ্যাকলেড’ নামে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্কলন করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গরুর গোশত সংক্রান্ত গণহিংসার শিকার হয়েছেন যারা তাদের সিংহভাগই মুসলমান – যারা গরুর গোশত খান বা বিক্রি করেন।

অন্যদিকে দলিত শ্রেণীর মানুষদের অনেকেই চামড়ার কাজে যুক্ত, যেজন্য তাদের মৃত গরু-বাছুর নিয়ে আসতে হয়।

এবারে সেই অজুহাত দেখিয়ে দলিত শ্রেণীর মানুষ গরুর গোশত সংক্রান্ত গণহিংসতার টার্গেট হতে চলেছেন কী না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস