হত্যা-ধর্ষণে জড়িয়ে ডিএসসিসি’র কাউন্সিলররা

ড. মজুমদার বলেন, ‘গণতন্ত্র আর সুশাসনের অভাবেই এমন ‘দুষ্টু’ লোকজন দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে কাউন্সির নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাই এদের থেকে সিটি কর্পোরেশনের আইন প্রয়োগ করেও ফল হবে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই ভালো কিছু আশা করা যাবে। নইলে মেয়র সাঈদ খোকনের নেয়া অনেক পদক্ষেপ ভুলন্ঠিত হবে বলে ড. মজুমদার মনে করেন।

বিডিসংবাদ ডেস্ক: রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। হত্যা, মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, দখল, ডিশ ব্যবসা ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন তারা। কেউ কেউ করপোরেশন পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলা ও স্থানীয় সরকার আইন (সিটি করপোরেশন আইন-২০০৯) ভঙ্গ করে ঠিকাদারি করছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কয়েকজন ফুটপাত, রাস্তা, এমনকি সরকারি জমি দখল করে স্থাপনা গড়ছেন। এতে বিফলে হতে বসেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের ‘সুন্দর ঢাকা গঠন’র কার্যক্রম।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের অব্যশই সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে সেবার বদলে জনগণ ভোগান্তিই পাবে। ’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কাউন্সিলরদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা করার কোনো আইনগত সুযোগ নেই। এ ছাড়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আচরণ কী হবে সিটি করপোরেশন আইনে তা সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, অনেকে অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র আর সুশাসনের অভাবেই এমন ‘দুষ্টু’ লোকজন দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে কাউন্সির নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাই এদের থেকে সিটি কর্পোরেশনের আইন প্রয়োগ করেও ফল হবে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই ভালো কিছু আশা করা যাবে। নইলে মেয়র সাঈদ খোকনের নেয়া অনেক পদক্ষেপ ভুলন্ঠিত হবে বলে ড. মজুমদার মনে করেন।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯-এর ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কাউন্সিলর তার স্বীয় পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন যদি তিনি (ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। অসদাচরণ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন বা বিধিনিষেধ লঙ্ঘন, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য তথ্য প্রদান করাকে বোঝাবে। ’

গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ডিএসসিসির ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বাসিত খান বাচ্চুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ধর্ষিতা মুগদা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেছেন। তাতে অভিযোগ করা হয়, ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে এক নারীর সহায়তায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে যান ভিকটিমকে। এরপর ওই কাউন্সিলর অফিসে আটকে রেখে ওই নারীকে ধর্ষণ করেন। এ বিষয়ে আব্দুল বাসিত খানের মন্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

ডিএসসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মেয়রের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন পশ্চিম ইসলামবাগের বাসিন্দা হাজি আব্দুল জলিল। তিনি কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম বাবুলের বিরুদ্ধে বাড়ি দখলের পাঁয়তারার অভিযোগ তুলেছেন। একইভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আউয়াল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা। লিখিত অভিযোগে তারা একটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই কাউন্সিলরের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া অস্ত্র ব্যবসা ও চাঁদাবাজির সঙ্গে আউয়াল সরাসরি জড়িত বলেও অভিযোগ করা হয়। আবদনে এ কাউন্সিলরের হাত থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সহায়তা চাওয়া হয়। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আউয়াল হোসেন দাবি করেন, ‘দুই বাড়ির লোকজনের কথা-কাটাকাটির সময় মোখলেছুর রহমান নামে একজন মারা যায়। কিন্তু মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন ষড়যন্ত্রমূলক হত্যা মামলা দায়ের করে আমাকে আসামি করেছে। ’

এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন,  ‘যে দুজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তা আইনানুগভাবে দেখা হবে। ’

গত বছর ডিএসসিসির অস্থায়ী কোরবানির হাট ইজারা নিয়েছিলেন ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ। ব্রাদার্স ইউনিয়নসংলগ্ন বালুর মাঠ এবং কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন আরেকটি হাটের বিপরীতে সর্বোচ্চ দরপত্র জমা দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে একাধিক জাতীয় দৈনিকে খবর আসার পর এ দুটি হাটের ইজারা বাতিল করতে বাধ্য হয় ডিএসসিসি। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধির এ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশ নেওয়া বারণ।

গত বছরের ১৪ মার্চ ডিএসসিসির পরিচ্ছন্নতা অভিযান ঘিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানের ব্যানারে নিজের নাম না দেখে সংস্থাটির দুই কর্মকর্তাকে মারধর করেন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন ও তার লোকজন। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) অফিস আঙিনায় তিনি ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় ও অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলামের গায়ে হাত তোলেন।

রাজধানীর সায়েদাবাদে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড বসিয়ে চাঁদা আদায় করে আসছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী হাবিবুর রহমান হাবু। সেখানে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর উচ্ছেদ অভিযানে যাওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন ডিএসসিসি ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের ওই কাউন্সিলর। এ ঘটনায় হাবুকে সাময়িক বরখাস্ত করে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়।

ঢাকার ধোলাইখাল দখলের অভিযোগ রয়েছে দুই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। খালের অংশে দলীয় কার্যালয় তৈরি করেছেন-এমন অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ওই দুই কাউন্সিলরকে তলবও করেছিলেন হাইকোর্ট। গত বছরের ১ নভেম্বর বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে ডিএসসিসির ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন এবং ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান হাবুকে উপস্থিত হয়ে জবাব দিতে হয়েছে।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ ভঙ্গ করে কাউন্সিলররা সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেছেন। অনেকে নিজেই আবার কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের নামে এ ব্যবসা করছেন। ডিএসসিসির ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম আশরাফ তালুকদার ‘আশরাফ এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে করপোরেশনে ঠিকাদারি করেন। একই সঙ্গে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ মনসুর আহমেদ, ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিছুর রহমান, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোস্তবা জামান পপি, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের তরিকুল ইসলাম সজিব, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সারোয়ার হাসান আলো ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন করপোরেশনের ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুরের ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯-এ কাউন্সিলরদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা বিষয়ে বলা আছে, ‘কাউন্সিলর পদে থাকবার যোগ্য হবেন না, যদি তার পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কার্য সম্পাদনের বা মালামাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হন বা এর জন্য নিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা সিটি করপোরেশনের কোনো বিষয়ে তার কোনো প্রকার আর্থিক স্বার্থ থাকে বা তিনি সরকার কর্তৃক নিযুক্ত অত্যাবশ্যক কোনো দ্রব্যের ডিলার হন।