বাংলাদেশে বিজ্ঞানের নাক্ষত্রিক আলোকবর্তিকা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া

মোঃ আনোয়ার হাবিব কাজল


বাংলাদেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার আজ ৮০ তম জন্মদিন। ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার অন্তর্গত পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম ‘মিয়া’ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবেই দেশবাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ জামাতা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী- এই দুই পরিচয় ছাপিয়ে তার ছিল নিজস্ব পরিচয় ও অবস্থান। তিনি একজন খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের ভৌতবিজ্ঞান সদস্য ছিলেন এবং পরে কমিশনের চেয়ারম্যানও নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তাকে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে সরকার।


নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে দেশ-বিদেশে তার যথেষ্ট পরিচিত ছিল। নিউক্লিয়াসের গড়ন ও নিউক্লীয় বর্ণালি বিষয় ছিল তার গবেষণার বিষয়। তিনি সর্বক্ষণ চিন্তা করতেন কীভাবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে পরমাণু শক্তি কমিশন প্রতিষ্ঠায় তার অবদান সর্বজনস্বীকৃত। পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এইআরই), সাভার এবং সেখানে স্থাপিত দেশের একমাত্র গবেষণা রি-অ্যাক্টর তার প্রচেষ্টার ফসল। এ ছাড়া কমিশনের বর্তমান প্রধান কার্যালয় ভবন তারই অবদান। ড. ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণামূলক লেখার মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন। তিনি বেশ কয়েকটি মূল্যবান বই (পদার্থবিজ্ঞান) রচনা করেন। ওইসব বই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে।


সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার। তার প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয় এবং অনুসরণীয়। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সার্ভিস রুল প্রণীত হয়। জাতীয় উন্নয়নে বিজ্ঞানের ভূমিকা এবং এ মহৎ লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৮১ সালে ঢাকার পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথম কৃষি গবেষণা কর্মকান্ড শুরু করে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে পৃথক হয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) নামে অভিহিত হয়। তার অবদান সবসময়ই স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবে।


ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালে ছাত্রলীগে যোগদান করলে তাকে ফজলুল হক হল শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সে সময় শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিভিন্ন দাবির জন্য ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে অন্যদের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েক মাস অন্তরীণ থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হন।
বঙ্গবন্ধু ড. ওয়াজেদ মিয়াকে রাজনীতিতে আনতে চাননি। বিজ্ঞানী হিসেবেই তাকে দেখতে চেয়েছেন। রাজনীতিতে তাকে কখনোই জড়ানোর চেষ্টা করেননি। ড. ওয়াজেদ মিয়া’র জীবনকে মূলতঃ দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমতঃ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী তার ছাত্র ও ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া জীবন এবং দ্বিতীয়তঃ তার বিজ্ঞান গবেষণায় নিবেদিত জীবন। তবে দ্বিতীয় জীবনেই বিজ্ঞানী হিসেবেই তিনি বেশী সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।


তিনি ১৯৬১ সালে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে যোগদান করার পর লাহোরে প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থায় বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে ওই কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এমএস ডিগ্রি এবং ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের ‘দারহাম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের অধীনে আণবিক শক্তি কেন্দ্র, ঢাকায় ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬৯ সালে ড. ওয়াজেদ মিয়া ইতালীতে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স এ অ্যাসোসিয়েট হন এবং সস্ত্রীক সেখানে অবস্থান করেন। সেখানে সাউথ কমিশনের চেয়ারম্যান বিজ্ঞানী সালাম এর সাথে পরিচয় হয় ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার। প্রফেসর সালাম উন্নয়নশীল বিশ্বের ভাগ্য উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারতেন না। ডঃ ওয়াজেদও বিজ্ঞানী সালামের আদর্শে যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ হন।
মুক্তিযুদ্ধকালে ড. ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন শেখ হাসিনা, বেগম মুজিব, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলের ভরসার স্থল। ড. ওয়াজেদ বঙ্গবন্ধুর ভবন ত্যাগ করে ধানমন্ডি ৮নং সড়কের বঙ্গবন্ধুর এক হিতাকাঙ্খীর বাসায় সবাইকে নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পর ওয়াজেদ রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত হবার পাশাপাশি আণবিক শক্তি কমিশন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সাভারে এ কমিশনের জমি গঠন থেকে শুরু করে এটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুরো কৃতিত্বটা তাকেই দেয়া যায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে র নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন তিনি স্ত্রীসহ পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। এ নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনায় তিনি প্রচন্ড রকম মানসিক আঘাত পান। যা তার সৃজনশীল জীবন থেকে কয়েক বছর কেড়ে নেয়। জীবনের শেষ প্রায় বিশ বছর তিনি মানসিকভাবে আহত ছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে কাছে থেকে যেভাবে সেবা শুশ্রুষা ও সাহচর্য দিয়েছেন, তা দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে।


ড. ওয়াজেদ মিয়ার বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবকাঠামো নির্মাণে, বিজ্ঞান সাধনা ও কর্ম চাঞ্চল্যতার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহের কারনেই বিজ্ঞান নিয়ে সারাজীবন কাটিয়েছেন। দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে তার মধ্যে হতাশা ছিল। বিশেষত আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তান বিজ্ঞানে অনেক দূর অগ্রসর হলেও আমরা পারিনি। আমাদের এই স্বাধীন দেশে এতগুলো সরকার ক্ষমতায় এলেও তারা বিজ্ঞান ও গবেষণা নিয়ে বড় কোন পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্যোগী হয়নি। দেশে আজ বিজ্ঞানের স্থান কোথায়? অথচ, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো বিজ্ঞান গবেষণায় ছোট-বড় অর্জন করেই চলেছে। অথচ, আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বিজ্ঞান গবেষণায় বিশেষ অর্জনে সক্ষম হইনি।
আমাদের দেশে বিজ্ঞানীদের সুযোগ দিলে দেশ বিজ্ঞানে অর্থনীতিতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমাদের খনিতে যে গ্যাস, কয়লা রয়েছে, তা যদি আমরা উত্তোলনের চেষ্টা করতাম, তবে আমাদের ইমেজ অন্যরকম হতে পারতো। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের কদর নেই, তাই বিজ্ঞানীদেরও কোন কদর নেই। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিজ্ঞানের সাব কমিটি থাকলেও, আমাদের দেশে তা নেই।


বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির সভাপতি হিসেবে বিজ্ঞান নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন ডঃ ওয়াজেদ মিয়া। তার স্বপ্ন ছিল দেশে একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মিত হবে, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাউন্সিল হবে, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন হবে, ন্যাশনাল সেন্টার ফর টেকনোলজি ডেভেলাপমেন্ট এন্ড ট্রান্সফার হবে, ন্যাশনাল সায়েন্স লাইব্রেরী, মিউজিয়াম অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি হবে। বিজ্ঞান ভবন ডিজাইন করা হলো, জায়গা ঠিক করা হলো, কিন্তু কেন যেন ভবন নির্মাণ হলো না। তার আরো স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানীদের একটি অ্যাপেক্স বডি তত্ত্বাবধান করবে। বিজ্ঞান ভবনে বসে বিজ্ঞানীরা দেশের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করবে। এখানে বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হবে।
ড. ওয়াজেদ মিয়া আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবে তার কর্ম পরিকল্পনা, স্বপ্ন ও কথাগুলো এখনো বক্তৃতা আকারে “ ঝঢ়ববপযবং ড়ভ ঃযব ইঅঅঝ চৎবংরফবহঃ” বইয়ে রয়ে গেছে। সেই স্বপ্নগুলো যদি বর্তমান সরকার বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেন, তবে একটি কাজের কাজ হয়। ৪০ বছরের পারিবারিক জীবনে ড. ওয়াজেদ মিয়ার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী তার পাশে থেকে যে ধৈর্য, সাহস ও সেবার পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, তা অসাধারণ ও অসামান্য। একজন বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আপনিতো বিভিন্ন দেশে ঘুরে বিজ্ঞানের আয়োজন, গবেষণা ও কার্যক্রম দেখেছেন, বিজ্ঞানের প্রয়োগ ছাড়া কি আমরা দিন বদল করতে পারবো, কিংবা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারবো? এ কথা মাথায় রেখে যদি দেশের বিজ্ঞানীদের দেশ গড়ার কাজে আপনার পাশে রাখেন, তাহলে এটুকু আশ্বাস রাখতে পারেন এ ব্যাপারে আপনি নিঃসঙ্গ থাকবেন না। বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতিসহ দেশের সকল বিজ্ঞানভিত্তিক সংগঠন, বিজ্ঞানী ও গবেষক ও বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তিত্বরা দেশের জন্য কল্যানকর সকল কাজে আপনার পাশে থাকবে। ড. ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে আজ ৮০ তম জন্মদিনে এই প্রত্যাশা রইল।