ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আসবে কবে

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

ভোলায় নতুন একটি কূপে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে বাপেক্স, যেখান থেকে কয়েক মাসের মধ্যেই পুরোদমে গ্যাস উত্তোলন শুরু করা যাবে বলে কর্মকর্তারা বলছেন। নতুন এই কূপ থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার আশা করছেন কর্মকর্তারা। সেই সাথে এই গ্যাস দেশের অন্য এলাকায় ব্যবহারের একটি পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে।

ভোলা জেলায় এ পর্যন্ত নয়টি কূপে ১.৭ ট্রিলিয়ন গ্যাস মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হলেও জাতীয় গ্রিডে নেয়া সম্ভব হয়নি।

শুক্রবার ইলিশার নতুন এই কূপ থেকে পরীক্ষামূলক গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়েছে। এটি শুরু হলো এমন সময় যখন বাংলাদেশে গ্যাসের তীব্র সঙ্কট রয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সার, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায়।

ভোলার গ্যাস কবে নাগাদ পুরোপুরি ব্যবহার করা যাবে? কবে থেকে এই গ্যাস অন্য এলাকায় পাওয়া যাবে?

ইলিশার নতুন গ্যাস কূপ
বাপেক্সের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোলার শাহবাজপুর আর ভোলা নর্থ নামে বর্তমানে আলাদা যে দুটি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, ইলিশার কূপটিকে তারা সেগুলো থেকে আলাদা বলে মনে করছেন।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এটা অবশ্যই একটা অনুসন্ধান কূপ। কিন্তু এটা একটা নতুন এলাকা।’

‘শাহবাজপুর বা ভোলা নর্থ ফিল্ড থেকে এটা আলাদা একটা এলাকা, মাটির নিচে আলাদা একটা ফল্টে রয়েছে। আমরা যে ৩২০০ থেকে ৩৫০০ মিটারের মধ্যে যে গ্যাসটা পেলাম, এটা নতুন একটা লেয়ার। ফলে এটা ওই দুইটার অংশ না,’ বলেন তিনি।

কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে মাটির প্রায় ৩৪০০ মিটার গভীরে চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গ্যাস রয়েছে।

বাপেক্সের কর্মকর্তারা বলছেন, আরো কিছু কারিগরি কর্মকাণ্ডের পর তারা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারবেন যে সেখানে আসলে কী পরিমাণ গ্যাসের মজুদ রয়েছে, চাপ কেমন রয়েছে এবং আর কোনো কূপ খনন করা যাবে কিনা।

বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স) এর তত্ত্বাবধানে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রম এই গ্যাসক্ষেত্রের কাজ করছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এটি যদি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র হয়ে থাকে তাহলে এটা এক বড় খবর।

‘এটা কি গ্যাসের একটি কূপ নাকি নতুন একটি ক্ষেত্র- তা বোঝা যাচ্ছে না। যদি নতুন একটি গ্যাস ক্ষেত্র হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে দেশের জন্য এটি একটি খুব বড় খবর যে এই গ্যাসের সঙ্কটের সময় আরো কিছু গ্যাসের খোঁজ পাওয়া গেল।’

নতুন গ্যাস কবে ব্যবহার করা যাবে
কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, ভোলার ইলিশা কূপে ১৮০ থেকে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে।

উৎপাদন শুরু হলে এখান থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। কিন্তু এই গ্যাস ব্যবহার-উপযোগী করে তুলতে কয়েক মাস লেগে যাবে।

পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে উৎপাদনের উপযোগী করতে আরো কমপক্ষে ১৫ দিন লাগবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, তিনটি স্তরে নতুন এ কূপটি পরীক্ষা করতে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে।

তবে কূপ থেকে পাওয়া গ্যাস ব্যবহার উপযোগী করতে হলে একে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়, কারণ গ্যাসের সাথে কাদামাটি, পানি ইত্যাদি মেশানো থাকে।

প্রসেস প্ল্যান্টের মাধ্যমে সেই গ্যাস প্রক্রিয়াজাত করে তা ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এ কাজের জন্য ইতোমধ্যেই টেন্ডার আহ্বান করেছে বাপেক্স।

সব মিলিয়ে এই কূপের গ্যাস ব্যবহার করতে আরো কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।

দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘ভোলার পাওয়া গ্যাস সেখানকার চারটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প প্রতিষ্ঠান, আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে ৮১/৮২ মিলিয়ন ঘনফুট প্রতিদিন ব্যবহার হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভোলায় আরো শিল্পকারখানা হলে সেখানে ব্যবহারের সুযোগ আছে।’

ভোলার গ্যাস দেশের অন্যত্র আসবে কবে
ভোলায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়া গেলেও দ্বীপ জেলা হওয়ার কারণে এবং পাইপলাইন না থাকায় বেশিরভাগই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এই নতুন গ্যাস পাওয়া অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু যতটা কাজে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে, আসলে সেটা ঘটছে না।’

‘কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত এটাকে আমরা গ্রিডে নিয়ে আসতে না পারব, ততক্ষণ সেটার পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না।’

বাপেক্সের দৈনিক উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ভোলার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সর্বোচ্চ নিলেও ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট ব্যবহার করে। আবাসিক ও অন্যান্য মিলে আরো কিছু গ্যাস ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ব্যবহার না থাকায় বাকি ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয় না।

ভোলায় যে পরিমাণ গ্যাসের মজুদ রয়েছে, তার তুলনায় পাইপলাইন বসিয়ে আনতে বেশি খরচ হবে- এই বিবেচনায় এতদিন ভোলা থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সঞ্চালনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।

সিলিন্ডারে করে ভোলার গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা
তবে বর্তমানে বিশ্ব বাজারে গ্যাসের চড়া দাম এবং দেশে গ্যাসের ঘাটতির কারণে ক্যাসকেড সিলিন্ডার পদ্ধতিতে হলেও ভোলার গ্যাস অন্যত্র সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৩৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে গ্যাসের সরবরাহ রয়েছে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রায় ছয় শ’ থেকে সাত শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে।

সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সিএনজিতে রূপান্তর করে কনটেইনারে ভরে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে এসে রফতানি নির্ভর শিল্পকারখানায় সরবরাহ করা হবে।

আপাতত শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে থেকে এই গ্যাস আনা হবে। গত মার্চ মাসে এজন্য ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগামী ১০ বছরের জন্য কোম্পানি এই কাজ পেয়েছে।

সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি জানিয়েছে, এভাবে গ্যাস সরবরাহ করার পূর্ণাঙ্গ সরকারি অনুমোদন এখনো তাদের কাছে আসেনি। সেটা পেলেই ইন্ট্রাকোকে কার্যাদেশ দেয়া হবে। সেটা কবে নাগাদ হতে পারে, তা জানা যায়নি।

প্রাথমিকভাবে পাঁচ এমএমসিএফডি করে গ্যাস ঢাকায় নিয়ে আসবে। এমএমসিএফডি হলো গ্যাসের দৈনিক কিউবিক ফুট। পরবর্তীতে কোম্পানিটি ২০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করবে।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এভাবে সিএনজি করে গ্যাস নেয়া গেলেও তার তো একটা লিমিট আছে। বেশি নিতে হলে পাইপলাইন করে নিতে হবে। ভোলায় যত গ্যাস আছে, তার বেশিরভাগই তো আমরা অন্যত্র নিতে পারছি না। সরকার নিশ্চয়ই সেটা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।’

কর্মকর্তারা জানিয়েছে, পদ্মা সেতু হওয়ার পর টেকেরহাট, বরিশাল হয়ে গ্যাসের একটি পাইপলাইন তৈরি করা লাভজনক হবে কিনা, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

অবশ্য অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন, ‘এভাবে পাইপলাইন করা হলেও সেটার ব্যয়ের তুলনায় লাভজনক হবে না। কারণ সেখানকার ভৌগলিক কারণে পাইপলাইন তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল হবে। এই কারণেই এর আগেও পাইপলাইনের কথা ভাবা হলেও কখনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’

তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, ভোলায় এই গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে যদি আরো কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা যায়, গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা সেখানে অন্য শিল্পকারখানায় ব্যবহার করা যায়, সেটা দেশের জ্বালানি খাত ও অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে।

গ্যাসের দাম কেমন হবে?
উত্তোলন করা গ্যাস বাপেক্স বিক্রি করে থাকে তিন টাকা চার পয়সা দরে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভোলা থেকে সিএনজি করে আনা গ্যাস পরিবহন ও প্রক্রিয়া খরচসহ প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম উদ্যোক্তা পর্যায়ে ৩০.৫০ টাকা আর গ্রাহক পর্যায়ে ৪৭.৬০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

তবে ফিড গ্যাসের মূল্য এবং কমপ্রেশন চার্জ যদি সরকার বা বাংলাদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন পুনর্নির্ধারণ করে, তাহলে এই মূল্যও পরিবর্তন হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের চড়া দামের কারণে এভাবে আনা হলেও সেটা সাশ্রয়ী হবে বলে তখন ধারণা করা হয়েছিল।

যদিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম আবার কমেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ আহমেদ বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের স্পট মার্কেটে কিন্তু গ্যাসের দাম এখন কমতির দিকে রয়েছে। ফলে সেখান থেকে আমদানি করলে গ্যাসের খরচ কেমন হবে, ভোলা থেকে গ্যাস আনলে কেমন খরচ হবে, এসব বিবেচনা করে হয়ত শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত আসবে।

কিন্তু ভোলায় গ্যাসের মজুদ থাকার পরেও এই ঘাটতির সময় যতটা সম্ভব সেটা ব্যবহার করার ওপর গুরুত্ব বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন এই বিশেষজ্ঞ।

সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস