স্যামসাংয়ের সংকট যেন গ্রিক ট্র্যাজেডি

স্যামসাং যুবরাজ লি জায়ে-ইয়োংয়ের বিরুদ্ধে ঘুষ ও তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি ঘিরে সৃষ্ট সংকটকে গ্রিক ট্র্যাজেডির সঙ্গে মেলানো যায়। এটা এমন গল্প, যেখানে উচ্চাভিলাষী এক সন্তান তার প্রবাদপ্রতিম বাবার স্থলাভিষিক্ত হতে চান এবং ভাগ্যের ফেরে সন্তান ও জনক দুজনই এক বাঁধনে আটকা পড়েন।

দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান লি জায়ে-ইয়োং। এ পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন করপোরেট সাম্রাজ্য স্যামসাং গ্রুপের আয় ২৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি। ইলেকট্রনিকস ও হাসপাতালের মতো চেনা ব্যবসার পাশাপাশি এ গ্রুপের পদচারণা রয়েছে আর্থিক সেবা, আতিথেয়তা, বায়োফার্মাসিউটিক্যালস ও ফ্যাশন শিল্পে।

৪৮ বছর বয়সী লি তার বাবার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতে তরুণ বয়স থেকে প্রস্তুতি নিয়েছেন। লির পিতা ও স্যামসাং চেয়ারম্যান লি কুন-হি দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ ধনী। সবাই তাকে কিংবদন্তি ব্যবসায়ী হিসেবে চেনেন, যিনি মামুলি অ্যাপ্লায়েন্স প্রস্তুতকারক স্যামসাং ইলেকট্রনিকসকে বৈশ্বিক ইলেকট্রনিকস জায়ান্টে রূপান্তর করেছেন। ২০১৪ সালে তার হার্ট অ্যাটাক হয়। তখন থেকে তিনি কোম্পানির নৈমিত্তিক ব্যবস্থাপনা থেকে দূরে রয়েছেন।

কয়েক মাস আগেও সবাই ভাবত, স্যামসাং চেয়ারম্যান পদে লি জায়ে-ইয়োংয়ের অভিষেক স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ১৯৯১ সালে স্যামসাং ইলেকট্রনিকসে যোগদানের পর থেকে লি ধাপে ধাপে এগিয়ে ভাইস চেয়ারম্যান পদে উন্নীত হয়েছেন। গত অক্টোবরে তিনি কোম্পানির নয় সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেন। সফটওয়্যার ও বায়োটেকের মতো সম্ভাবনাময় অঙ্গনে কোম্পানিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার।

ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান সিএলএসএর গবেষক শন কোশরান বলেন, লির বাবা বিরাট শিল্প কাঠামো গড়েছেন। লির লক্ষ্য ছিল ওই কাঠামো ও কর্মধারার আধুনিকায়ন এবং একই সঙ্গে কোম্পানির ঐতিহ্য ও মূল ব্যবসাগুলো ধরে রাখা। এ ধরনের কাজ কারো জন্যই সহজ নয়। তবে লি দুটি পৃথক পৃথিবীতে সেতুবন্ধ গড়ার মতো অনন্য অবস্থানে রয়েছেন।

সবশেষে আইনি জটিলতায় পড়ার আগে লি স্যামসাং ইলেকট্রনিকসে পরিবর্তনের প্রয়াসী ছিলেন। প্রবৃদ্ধির নতুন উত্স খুঁজতে গত তিন বছরে তিনি লুপপে, ভিভ ল্যাবস ও হারম্যান ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করেন। কোম্পানিতে তিনি আর্থিক শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তিনি স্যামসাংয়ের করপোরেট প্রাইভেট জেটগুলো বিক্রি করে দেন।

প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপলের সঙ্গে স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের অম্লমধুর সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় লি বড় ভূমিকা রাখেন। পেটেন্ট নিয়ে দুপক্ষের মামলা চললেও স্যামসাং কিন্তু অ্যাপলের আইফোন উদ্যোগের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সাপ্লাইয়ার। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়েছেন লি। ২০১১ সালে তিনি স্টিভের শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন।

গ্যালাক্সি নোট সেভেন স্মার্টফোন বিপর্যয়ের কারণে লির সাফল্যে দাগ পড়েছে। এ বিপর্যয়ে কোম্পানির ৬০০ কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হতে পারে। অ্যাক্টিভিস্ট হেজ ফান্ড এলিয়ট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনের দিক থেকেও লি চাপের মুখে ছিলেন। এলিয়ট ম্যানেজমেন্ট স্যামসাংয়ের মালিকানা কাঠামো সহজ করতে চাপ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি স্যামসাংয়ের পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকারীদের ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বিশেষ ডিভিডেন্ড দেয়ার জন্যও চাপ দিচ্ছে।

লি এখন যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, তার তুলনায় আগের সমস্যাগুলো ছোট। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পাক কুন হে ও তার বান্ধবীকে ঘিরে দুর্নীতি ও অন্যায় প্রভাব খাটানোর মামলায় লিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হানসুং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর কিম সাং-জো মনে করেন, লিকে জেলে পাঠানো হলে স্যামসাংয়ে নেতৃত্বের পালাবদল পিছিয়ে যাবে। একই কারণে স্যামসাং গ্রুপের পরবর্তী নেতা হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হতে পারে।

লিকে নিয়ে চলমান আইনি জটিলতা কোরীয় কৌঁসুলিদের সঙ্গে তার বাবা লি কুন-হির লড়াইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। লির বাবা বিভিন্ন সময়ে কর ফাঁকি, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে ঘুষ দেয়া এবং স্যামসাংয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে লোকসানের সময় দায়িত্বে অবহেলার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন।

আইন-আদালতের সঙ্গে সৃষ্ট জটিলতা ছাড়া বাবা ও ছেলের মধ্যে মিল কম দেখা গেছে। দুজনের নেতৃত্বের ধরন পরস্পরের বিপরীত। লি কুন-হির সামনে অধীনস্থরা ভয়ে থাকেন। কিন্তু তার ছেলে অন্যের মতকে নিজের মতের চেয়ে প্রাধান্য দিতে জানেন। এছাড়া তার চরিত্রে বিশ্লেষণ ও সমন্বয়ের প্রবণতা জোরালো। লি জায়ে-ইয়োং সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কেইয়ো ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ফসল। হার্ভার্ডে ডক্টরাল ডিগ্রির জন্য কাজ করলেও লি তা শেষ করেননি। জাপানি ও ইংরেজি ভাষায় তার সমান দক্ষতা।

সুইডেনের ব্যবসায়ী গোরান মাম দুই প্রজন্মের কাজের ধরনে বড় বৈপরীত্য লক্ষ করেছেন। ১৯৯৪ সালে গোরান জেনারেল ইলেকট্রিক মেডিকেল সিস্টেমসের এশিয়া অঞ্চলের সিইও ছিলেন। জিই চেয়ারম্যান জ্যাক ওয়েলশের সঙ্গে তিনি সিউলে লি কুন-হির বাড়ি যান। স্যামসাং হসপিটালসে টিস্যু স্ক্যানার বিক্রির উদ্দেশ্যে তারা সেখানে গিয়েছিলেন। লি তার বাড়ির সুপরিসর এক কক্ষে বসেছিলেন। অধীনস্থ কয়েকজন কর্মী তাকে ঘিরেছিলেন। পুরো সাক্ষাতে লি কুন-হি দাপটের সুরে কথা বলেছিলেন।

বেশ কয়েক বছর পর স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের পর্ষদ গোরানকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানায়। চেয়ারম্যান লি কুন-হি এসব বৈঠকে যোগ দিতেন না। কিন্তু সে সময় ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের লি জায়ে-ইয়োং প্রতিটি বৈঠকে চুপচাপ বসে সবার কথা শুনতেন। তার সঙ্গে সহজেই কথা বলা যেত।

লি জায়ে-ইয়োংয়ের মামলার ভবিষ্যত্ বলা যাচ্ছে না। দোষী সাব্যস্ত হয়ে তিনি জেলে গেলে স্যামসাংকে বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজতে হবে। আপাতত কোনো বিশ্বস্ত সহযোগী, পদস্থ নির্বাহীদের বিশেষ কমিটি অথবা লির বোন তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। হয়তো হুন্দাই মোটর ও এসকে গ্রুপের কর্ণধারদের মতো তিনি জেল থেকে ব্যবসা পরিচালনা করবেন। সরকারি ক্ষমার সুবাদেও লি স্যামসাংয়ে ফিরতে পারেন; যেভাবে তার বাবা দুবার ফিরেছিলেন। সূত্র: ব্লুমবার্গ