শীতের শুরুতেই চট্টগ্রাম শহরে মশার উপদ্রব নিধনে চসিকের কোন কার্যকরী উদ্যোগ নেই

চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ  শীত শুরুর সাথে সাথে মশার উপদ্রপ বেড়ে গেছে চট্টগ্রাম শহরে। দিনে-রাতে সমানে নগরীর সর্বত্র চলছে মশার উৎপাত। চুষে নিচ্ছে নগরবাসীর রক্ত। মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। বাড়ছে মশাবাহিত রোগ। অথচ মশা নিধনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) এখনো পর্যন্ত নেই কোন উদ্যোগ।

সারাদেশে চিকনগুনিয়া বিস্তারের প্রেক্ষিতে গত জুলাই ও আগষ্ট মাত্র দুই মাসের জন্য মশা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করেই দায়িত্ব শেষে করেছে চসিক। তখন পুরো সময়জুড়ে চট্টগ্রাম নগরীতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ছিল। পানি প্রবাহমান থাকায় তখন মশার প্রজনন তেমন হয়নি।

বর্তমানে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখন নালা-নর্দমায় জমে থাকা পানির কারণে মশার প্রজনন হার অন্য সময়ের তুলনায় বেড়েছে। সেই সাথে বাড়ছে মশার উপদ্রব। শুধু রাতে নয়, দিনেও সমানতালে কামড়ে গিলে খাচ্ছে নগরবাসীর শরীরের রক্ত।

এতে বাড়ছে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়াসহ নানা রকম চর্ম রোগীর সংখ্যা। ছড়িয়ে পড়ছে মশাবাহিত নানা রোগ। ভোগান্তিতে পড়েছে জেএসসি-জেডিসি ও পিইসি পরীক্ষার্থীরা।

নগরীর পশ্চিম মাদারবাড়ির গৃহিণী আয়শা বেগম জানান, মশার উৎপাতে সন্ধ্যার পর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতে হয়। তারপরও রেহাই নেই মশার কামড় থেকে। সন্ধ্যার পর ছেলেমেয়েদের মশারি টানিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। এমনকি দিনেও ঘরে-বাইরে টেকা দায়।

নগরীর হেলদি ওয়ার্ড জামালখানে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে ভাসমান দোকানে চা পান করছিলেন অটোরকিশা চালক আল- আমিন। এ সময় তিনি হাতে-পায়ে, গালে শুধু চড়-থাপ্পড় মারছিলেন। সেখানে বসা অন্য চা পানকারীদেরও একই দশা। আল আমিন এ সময় বলেন, মশা তো শুধু রক্ত গিলে খাচ্ছেই না , পুরো শরীরের উপর দিয়ে যেন তুফান বইয়ে নিচ্ছে।

ভুক্তভোগী কয়েকজন জানান, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকের চেম্বারে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বেশিরভাগ রোগীই এখন মশা আক্রান্ত। যাদের মশা থেকে বাচার তাগাদা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে গত অক্টোবর মাসে ১৬৬ জন চিকুনগুনিয়া এবং ৩৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৯৭৬ জন। নগরীর বিভিন্ন সরকার বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের চেম্বারেও দেখা গেছে মশাবাহী নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর ভীড়।
মশার উৎপাত থেকে বাঁচতে বাজারের বিভিন্ন কয়েল ও স্প্রে ব্যবহারেও নিস্তার মিলছে না বলে জানান রোগীদের অনেকে। মশক নিধনে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি আর্থিক ব্যয়ও বেড়েছে বলে জানান রোগীরা।

নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ নালা-নর্দমা, সড়কের আশপাশ, ফুটপাত, ডাস্টবিনসহ বিভিন্ন স্থান ময়লা-আর্বজনায় ঠাসা। রিয়াজউদ্দিন বাজারের মুখে, চকবাজার কাঁচাবাজারের সামনে, মাঝির ঘাট এলাকার ছোট ছোট খাল-নালা-নর্দমা, চাক্তাই এলাকার খাল, সিনেমা প্যালেস, শুভপুর বাস ষ্টেশন, মির্জাপুল এলাকার খাল, বাকলিয়ার বগার বিল এলাকার নালা-নর্দমাসহ নগরীর বিভিন্ন ছোট ছোট খাল ও নর্দমা আবর্জনার স্তুপে ভরে গেছে। ডাস্টবিনের আবর্জনা যথাসময়ে সরিয়ে না নেয়া এবং নালা-নর্দমা আবর্জনায় ভরে উঠার কারণেও নগরীতে মশার উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে নগরবাসীর অভিযোগ।

চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের পরিচালক শৈবাল দাস জানান, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছর নগরীর বিভিন্ন বাসাবাড়িতে মশা ধ্বংসকারী ওষুধ ছিটানো হতো। এ ছাড়া বর্ষা মওসুম ছাড়া বছরের অন্য দিনগুলোতে নালা-নর্দমায় লাইট ডিজেল এবং লিমব্যাক (লাল তেল নামে পরিচিত) নামক মশার ডিম ধ্বংসকারী একটি তেল ছিটানোর ক্রাশ প্রোগ্রাম নগরজুড়ে দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই কার্যক্রম দৃশ্যমান হয় না।

সিটি কর্পোরেশনের অপর একটি সূত্র ওষুধ ছিটানোর চাইতে মশার প্রজনন ক্ষেত্র খাল ও নালা পরিচ্ছন্ন রাখাকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যথাযথভাবে নালা-নর্দমা, ডোবা ও খাল পরিষ্কার না হওয়ায় কাঙ্খিত ফলাফল মিলছে না। সিটি কর্পোরেশনের প্রথম থেকে মশক নিধন কার্যক্রম চালু থাকার কথা বলা হলেও নগরজুড়ে মশার উৎপাত অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী জানান, মশক নিধনে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া ক্রাশ প্রোগ্রাম এখনো চলমান আছে। তবে চসিকের মশা নিধন প্রোগ্রামের চেয়ে জনগনকে মশা নিধনে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি জানান, গত জুলাইয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ ও নিধনে ক্রাস প্রোগ্রামের আওতায় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ২০০ লিটার করে সার্ভেসাইড (মশার ডিম ধ্বংসকারী

ওষুধ) এবং ৬০০ লিটার করে এডালটিসাইড (পূর্ণবয়স্ক মশা ধ্বংসকারী ওষুধ) ছিটানোর কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়।

মশা নিধনের এ ক্রাশ প্রোগ্রামের জন্য চসিকের বাজেট রয়েছে ২ কোটি টাকা। তা বাড়িয়ে এ প্রোগ্রামে ৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন প্রতিবছর দেড় কোটি টাকার কালো তেল ক্রয় করে। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতি ওয়ার্ডে চারজন করে (অতিরিক্ত ৩৬ জনসহ) মোট ২০০ জন কর্মী মশক নিধন কার্যক্রমে নিয়োজিত আছে।

চসিক মাসে ৪০০ লিটার কালো তেল ও ৪০০ লিটার লাইট ডিজেল স্প্রে ব্যবহার করে। এছাড়া বছরে ২০ থেকে ৩০ হাজার লিটার ভিকন ও ৩০ হাজার লিটার অ্যাডটিসায়েড ব্যবহার করা হয়। ৩০০টি হ্যান্ড ¯েপ্র মেশিনের মাধ্যমে প্রতিদিন সকালে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে। চসিকের কাছে ২০ হাজার লিটার কালো তেল মজুদ রয়েছে। বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার মশা নিরোধক কালো তেল পদ্মা ওয়েল কো¤পানি থেকে ক্রয় করা হয়। মশক নিধন কাজে ব্যবহিত ফগার মেশিন রয়েছে ৪০টি, এডালডিসাইড ৪০০টি এবং পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী পাওয়ার স্প্রে মেশিন রয়েছে ১০টি।

এছাড়া ডিম ধ্বংসকারী লার্বিসাইডও রয়েছে চসিকের কাছে। মশক নিধন কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয় লাইট ডিজেল এবং স্কটল্যান্ডের তৈরি লিমবেক (লাল তেল নামে পরিচিত) নামক মশার ডিম ধ্বংসকারী একটি তেল। কর্পোরেশন থেকে প্রতি মাসে প্রতি ওয়ার্ডে দশ হাজার লিটার লাইট ডিজেল এবং পাঁচ হাজার লিটার লিমবেক সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও আবেদনের ভিত্তিতে একজন আবেদনকারীকে আড়াইশ গ্রাম কালো তেল বিনামূল্যে দেয়া হয়।

তবে কাজির দেউরি বেটারী গলির বাসিন্দা জাফর চৌধুরী বলেন, চসিক সারাবছর মশা নিধনের কথা প্রচার করে। কিন্তু সে কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়ে না। দুইমাসের ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হলেও দুইদিন পরে সেই কার্যক্রমও উধাও হয়ে যায়।