আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের গতিপথ ঠিক করবেন, আশা বিএনপির

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আগামী নির্বাচন ও রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবেন এবং নতুন আশার আলো দেখাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছে বিএনপি।

বর্তমান মেয়াদে সরকারের তিন বছর পূর্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় আজ শুক্রবার বিএনপি তাদের এই আশার কথা জানিয়েছে। গতকাল রাতেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বিএনপি। আজ গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বিভিন্ন ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেছিলেন, সব দল নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখবে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।
এর প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা তো নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’
বিএনপির মহাসচিব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য কিছু পূর্বশর্ত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ, সাহসী, যোগ্য নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন হতে হবে। সে জন্য সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিরোধী দল নির্মূল করার যে প্রক্রিয়া চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে হবে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সভা, মিছিল, সমাবেশ করার সমান সুযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক পথে চলতে দিতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির নেতাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ‘অন্যায়ভাবে’ সাজা দেওয়া, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
ফখরুল অভিযোগ করেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বিরোধী দলকে দায়ী করে জঙ্গিবাদকে আরও প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার।
মির্জা ফখরুল দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের কথা বলেছেন, যা সঠিক নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এমনভাবে চিত্রায়িত করেছেন যে সব উন্নয়ন তাঁর দুই দফার সরকারের আট বছরেই হয়েছে, যা সঠিক নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ভিত্তি তৈরি করতে হয়, এরপর একটি একটি করে ইট লাগাতে হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন অবদানের কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, বৈধ-অবৈধ প্রায় সব সরকারই উন্নয়নে কমবেশি কাজ করেছে। তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজগুলো কোনো একটি বিশেষ সরকারের একক প্রচেষ্টার ফসল নয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনৈতিক এবং শুধু আত্মতুষ্টির প্রচেষ্টা।
মির্জা ফখরুল দাবি করেন, উন্নয়নের নামে সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। গত আট বছরে ধনী আরও ধনী, গরিব আরও গরিব হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা বেড়েছে। নজিরবিহীন দলীয়করণ, প্রশাসন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু করেছে। জবাবদিহির অভাব, অকার্যকর সংসদ দুর্নীতিকে লাগামহীন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ধ্বংসের মুখে। শেয়ার মার্কেট লুট, ব্যাংক লুট, দলীয় ব্যক্তিদের জন্য ঋণসুবিধা ও ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা অর্থনীতিকে ভেতরে-ভেতরে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলছে।
বিএনপির মহাসচিব দাবি করেন, বারবার জিডিপির হিসেবের বিভ্রাটে ফেলা হচ্ছে জাতিকে। বিএনপির আমলে জিডিপি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছিল, বর্তমান সরকারের আমলে তা বরং হ্রাস পেয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, পদ্মা সেতু, মালিবাগ ফ্লাইওভারসহ প্রায় সব কটি ফ্লাইওভারের প্রকল্প ব্যয় কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে। সরকার মেগা প্রকল্প গ্রহণে বেশি আগ্রহী, কারণ এতে তারা মেগা চুরির সুযোগ সৃষ্টি করে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের ভবিষ্যৎ কী, জনগণ তা জানতে চায়। তিনি দাবি করেন, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই। সরকারদলীয় লোকজনের চাঁদাবাজি, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে বিনিয়োগ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁর সরকার শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেছে। গত আট বছর ধরে এ দেশে শিক্ষার কী উন্নতি হয়েছে, তা জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সরকার শিক্ষার গুণগত মান ধ্বংস করে দিয়েছে।
মির্জা ফখরুল দাবি করেন, মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত। আইনের শাসন অনুপস্থিত। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। দেশে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুণ্ঠন।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।