রবিন ঘোষের ১ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ(এক্সক্লুসিভ ভিডিও)

জাঈনতাহুর শামস: উপমহাদেশের খ্যাতিমান সুরকার রবিন ঘোষের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৩ ফেব্রয়ারি ২০১৬ সালের আজকের এই দিনে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।

একজন সাদামনের মানুষ রবিন ঘোষ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে…’ গানটি যদি রবিন সাহেব আমাকে দিয়ে জোর করে না লেখাতেন তাহলে কে আমাকে বিশেষ এই গানটির জন্য মনে রাখতন। এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলেন গীতিকার-কবি কেজি মোস্তফা। তিনি বলেন, গানটি আগেই সুর করা ছিল, সুরকে ফলো করে গানটি লিখতে হয়েছে। এটা একটা কঠিন কাজ, তার তাগিদ ছাড়া কখনোই এটা সম্ভব হতো না। এরপর সবকিছু তো কালের সাক্ষী।

পরিচালক আজিজুর রহমান রবিন ঘোষের শৈশব নিয়ে জানান, রবিন ঘোষ জন্মেছেন ইরাকের বাগদাদে এক খ্রিস্টান পরিবারে। মা বাগদাদের আর বাবা বাংলাদেশের নরসিংদীর। বাবা ছিলেন একজন ইংরেজ বাহিনীর কর্মকর্তা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবা সৈনিকের কাজে ছিলেন বাগদাদে। পরে যুদ্ধের ক্রমাগত হুমকির মুখে তিনি সপরিবারে ১৯৪৫ সালে দেশে চলে আসেন। পরবর্তীকালে রেডিও পাকিস্তানে চাকরি করার সুবাদে ১৯৬০ সালে প্রখ্যাত পরিচালক এহতেশামের সঙ্গে পরিচয়। পরে তাকে ‘রাজধানী বুকে’ ছবির জন্য ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে নির্বাচন করেন তিনি। ওই ছবিতে কেজি মোস্তফার লেখা ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে গানটি এখনো রোমান্টিক গানের সেরার কাতারে চিরভাস্বর। রবিন ঘোষরা চার ভাই, এক বোন। প্রয়াত পরিচালক অশোক ঘোষ তার ছোট। বর্তমানে এক ভাই আমেরিকায় বসবাস।

রবিন ঘোষ ষাটের দশকের শেষদিক থেকে সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে ঢাকা-লাহোর-করাচিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সে সময় তার সুর-সংগীতায়োজনে হারানো দিন ছবির ‘আমি রূপ নগরের রাজকন্যা রূপের জাদু’, নাচের পুতুল ছবির মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠে ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের মুখে মুখে ফিরত কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখে গাইতে শোনা যেত ‘পিছ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি’ গানটি। একই সময় তার সুর-সংগীতে পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দুতে বাজত শরাফত ছবির ‘যাও তুমহে পেহসান লিয়’, জিঞ্জির ছবিতে ‘গুলবাহার মে হুঁ গুলবাহার’ জমিন আসমান ছবির ‘তুঝছে উমিদ নেহি ও মেরা বাছপান কি সাথ’, অঙ্গার ছবিতে নূরজাহানের কণ্ঠে চিঠি যারা সাইদিকা নাম লিখদে’, আয়না ছবিতে মেহেদী হাসানের কণ্ঠে ‘মুঝে দিলসে না ভুলানা’, ‘ওয়াদা কারো সাজনা’ প্রভৃতি গান এখনো সমান জনপ্রিয় উপমহাদেশে।
বাংলাদেশে রবিন ঘোষের সংগীতায়োজনে সর্বাধিক ছবির নায়িকা অঞ্জনার অভিজ্ঞতায়, ‘তিনি অনন্য প্রতিভার অধিকারী। তাকে এ দেশ খুব বেশি মূল্যায়ন করেনি। আমার মনে পড়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা, ‘আপোষ’  (কো-প্রডাকশন-১৯৮৭) ছবিতে ‘ও আমার প্রাণেরও সুজন’ গানটি সাবিনা আপার কণ্ঠে দেওয়ার আগে তিনি নুরুল হক বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কে গানে লিপ করবে? যখন জানলেন আমি করব তখন সুরটা মেলোডিয়াস করে মিউজিক ট্র্যাক পরিবর্তন করেছিলেন।’

তবে রবিন ঘোষের বিষয়ে সবচেয়ে জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য করেছেন গীতিকার অধ্যাপক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি বলেছিলেন, ‘সুরকার হতে হলে রবিন ঘোষের মতো হওয়া চাই।’

বাংলা খুব বেশি ছবিতে রবিন ঘোষ কাজ করেননি, তবে যে কটি ছবিতে কাজ করেছেন তা শ্রোতা মাঝে এখনো বরণীয়। বাংলাদেশে তার শেষ ছবি অশোক ঘোষ পরিচালিত আমার সংসার (১৯৯২)। এরপর মৃত্যু অবধি তাকে আর কোনো সিনেমায় সংগীত পরিচালনায় দেখা যায়নি।

জানা গেছে, মৃত্যুর আগে তার আক্ষেপ ছিল, তিনি হয়তো বাংলাদেশের শ্রোতাদের কিছু দিতে পারেননি। তিনি কী ভেবে এই আক্ষেপ করেছেন জানি না, তবে শ্রোতারা তাকে ঠিকই মনে রাখবে আর আয়নাতে মুখ রেখে গুনগুনিয়ে রবিন ঘোষকে খুঁজবে।