ম্যারাডোনাকে আনতে রাস্তায় নেমে অর্থ জোগাড় করেছিল যে শহরের মানুষ

বিডিসংবাদ অনলাইন ডেস্কঃ

ইতালির দক্ষিণের শহর নেপলস, যার পরিচয় ছিল একসময় মাদক, মাফিয়া ও অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসেবে। নেপলসের কথা উঠলেই সামনে এসব ভেসে উঠতো। কিন্তু এখন থেকে ৩৯ বছর আগে এই শহরের পরিচিতি বদলে দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার দিয়েগো ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনা ১৯৮৪ সালে যখন ইতালির নাপোলি ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন বিশ্ব ফুটবলের শীর্ষ তারকাদের একজন। স্পেনের বার্সেলোনা ছেড়ে তিনি ইতালির নাপোলিতে যোগ দেন। বার্সেলোনার তুলনায় নাপোলি তখন ছিল অনেক অপরিচিত একটি দল।

ম্যারাডোনা বলেছিলেন, নেপলস একটা পাগলা শহর, অনেকটা তার মতোই। সেখানে ফুটবলই জীবন। এই শহরের মানুষের ভালবাসো তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছেন। ম্যরাডোনার জীবন নিয়ে বই ‘টাচড বাই গডে’-এ এসব কথা উঠে এসেছে।

ন্যাপলিটনরা পেয়েছিলেন গৌরবের উপলক্ষ এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। শুধু তাই নয়, নেপলসের সাথে পুরোপুরি মিশে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সেই ম্যারাডোনাকে এখনো নেপলসে আরাধনা করা হয়।

ম্যারাডোনা নাপোলিতে যোগ দেবার তিন মৌসুম পরেই ইতালির লিগে চ্যাম্পিয়ান হয় নাপোলি। বিশ্ব ফুটবলে নাপোলি হয়ে উঠে এক পরিচিত নাম। ম্যারাডোনা নাপোলি ছাড়ার ৩৩ বছর পর নাপোলি আবারো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

ম্যারাডোনার জন্য রাস্তায় অর্থ তোলা
নেপলসে এসেই ম্যারাডোনা অনুভব করেন এই শহর ও এর মানুষেরা এমন সব সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছেন যা ম্যারাডোনা নিজের জীবনে টের পেয়েছেন।

ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত জীবনের মতোই নেপলস শহর ছিলে অগোছালো। এই শহরের মানুষ দরিদ্র হলেও তারা ছিলেন প্রচণ্ড আবেগী। এখানেই ম্যারাডোনা নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন।

ন্যাপলস শহরটা ইতালির শহর হলেও ঠিক ইতালিয় নয়, এখানে দরিদ্রতা, বেকারত্ব ও সন্ত্রাস ছিল তুঙ্গে।

ম্যারাডোনাকে বার্সেলোনা থেকে নিজেদের ক্লাবে সই করাতে স্পেনে গিয়েছিলেন নাপোলির স্পোর্টিং ডিরেক্টর অ্যান্তোনিও জুলিয়ানো, তিনি নিজেও ন্যাপলসের এক বস্তিতে বড় হয়েছেন।

তিনি ম্যারাডোনাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই বলে, “ন্যাপলসে এলে তুমি হবে জীবন্ত এক ঈশ্বর। লোকে তোমার জন্য মরতেও রাজি”।

ম্যারাডোনাকে তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি দিয়ে কিনেছিল নাপোলি, তবে বার্সেলোনা প্রেসিডেন্ট শেষ মুহূর্তে এসে আরো ৫ লাখ পাউন্ড দাবি করে বসেন।

এই অর্থ জোগাড় করার জন্য নেপলসের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। ফুটবল বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘গোল ডটকম’ এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে সে কথা তুলে ধরেছেন কার্লো গার্গানিজে। তিনি ইতালির একজন শীর্ষ ফুটবল বিষয়ক সাংবাদিক।

তিনি লিখেছেন, ন্যাপলসের লোকেরা পথে নেমে পড়েন, সবার কাছ থেকে অর্থ তোলা শুরু করেন, কুখ্যাত জনাকীর্ণ বস্তি থেকে ওঠে ম্যারাডোনার ট্রান্সফারের জন্য বাড়তি চাওয়া অর্থ।

সেদিন ম্যারাডোনারও বিশ্বাস হয়, “এই লোকেরা আমার জন্য মরতেও রাজি”।

ম্যারাডোনা ছিলেন ‘ঈশ্বরের’ মতো
ইতালির নেপলস শহরে মানুষের কাছে এতো বছর পরেও ম্যারাডোনা ‘ঈশ্বরের’ মতো ম্যারাডোনার এই পরিচয় আরো স্পষ্ট হয়েছে ৩৩ বছর পর আবারো নেপলি যখন ইতালিয়ান লিগ জেতে।

এই শহরের মানুষ ফুটবল নিয়ে এতোটাই পাগল যে গোটা রাত ধরে চলেছে আতশবাজি ফুটিয়ে জয়োৎসব।

বিবিসির ফুটবল ফোকাসের করা একটি ডকুমেন্টারিতে নেপলসের এক ফুটবল সমর্থক বলেন, “ফুটবলই আমাদের কাছে সবকিছু”।

“খুশি, ভালোবাসা, কষ্ট- সবই ফুটবল, আমরা কিন্তু ইতালির পরিচয় আগে দেই না, আমরা আগে ন্যাপলিটন, এরপর ইতালিয়ান”।

এই ডকুমেন্টারিতে ক্যালসিওন্যাপোলি টোয়েন্টি ফোর টিভির সাংবাদিক ভিনসেঞ্জো ক্রেডেনডিনো নিজের ছোটবেলার একটি খেলা দেখার স্মৃতিচারণ করছিলেন।

“বাবার সাথে গিয়েছিলাম ম্যাচ দেখতে, আমি প্রশ্ন করেছিলাম আমরা কাকে সাপোর্ট করছি? বাবা বলেছিলেন, নীল জামা পরা লোকদের।”

“আমি প্রশ্ন করেছিলাম কেন? বাবা দুটি উত্তর দিয়েছিলেন, এক এটা আমাদের শহরের দল, দ্বিতীয়ত ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা”।

ম্যারাডোনা নাপোলিতে এমনই এক চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আর্জেন্টিনার এক ফুটবলার, পেশার কারণে ফুটবল খেলতে এসে ইউরোপের একটি শহরের কাছে হয়ে উঠেছিলেন, ‘মেসিয়াহ’ বাংলায় যাকে বলে ‘অত্যাচারিত জাতির জন্য মুক্তিদাতা।’

নেপলির সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সেস্কো ক্যারিন্যানি বিবিসির ফুটবল ফোকাসে বলেন, ইতালির সাথে নেপলসের একটা ঐতিহাসিক বিরোধ ছিল। এটা অনেকটা দক্ষিণের সাথে উত্তরের বিরোধের মতো একটা দ্বন্দ্ব, যা আপনি না চাইলেও মনে চলে আসে।

“নেপলসের লোকেরা সবসময় মনে করে এসেছে ইতালি নেপলসকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়নি, আর ইতালির অন্যান্য শহরের অনেক লোকই ন্যাপলিটনদের খাটো করে দেখতো”।

“দক্ষিণের ইতিহাস নিয়ে আমরা গর্বিত কিন্তু বিত্তবানরা বাস করতেন উত্তরে”।

নাপোলির সাথে সম্পর্ক ভালোবাসার
ম্যারাডোনা তখন শুধু একজন ফুটবলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার থেকে অনেক বেশি। তিনি শোষকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।

“একারণেই নেপলসের মানুষ ভেবে নিয়েছিল তখন, হয়তো সাধারণ মানুষের জন্য ম্যারাডোনা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন,” ফ্রান্সেস্কো ক্যারিন্যানি

নাপোলির এক ফুটবল সমর্থক বলেন, “হয়তো তিনি ঈশ্বর, হয়তো সাধু, হয়তো প্রেসিডেন্ট, হয়তো তিনিই সবকিছু”।

ম্যারাডোনাকে অনেকটা পোপের মতো দেখা হতো নেপলসে। তাদের বিশ্বাস ম্যারাডোনা এই শহরে বিরাজ করেন এখনো। বাস্তবে না হলেও, ম্যারাডোনার অস্বিত্ব আছে ন্যাপলসের দেয়ালে, ১০ নম্বর জার্সিতে এবং মানুষের মনে।

“তখন দেখা যেত কোনো মা ও মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে এবং পথে ম্যারাডোনার সাথে দেখা হলো, মা মেয়েটিকে ম্যারাডোনার কাছে এগিয়ে দিয়ে বলবে, আমার মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে আশীর্বাদ করো”, বলছিলেন ভিনসেঞ্জো ক্রেডেনডিনো।

ম্যারাডোনা নাপোলিতে এসেই এই ক্লাবের রূপ বদলে দিয়েছিলেন ৩০-৩৫ বছর আগে, ১৯৮৬-৮৭ এবং ১৯৮৯-৯০ এর ইতালিয়ান লিগ জিতেছিল নাপোলি, সেবারের পর এই ২০২৩ সালে আবারো শিরোপা এলো নেপলসে।

তবে ম্যারাডোনা শুধু ইতালিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি জয়ের ধারা, ইউরোপিয়ান শিরোপাও এনে দিয়েছিলেন নাপোলিকে।

লিগ জয়ের পর নাপোলির এক সমর্থক প্রশ্ন তোলেন, “ন্যাপলস থেকে ম্যারাডোনাকে কখনোই কি আলাদা করা যাবে?”

নাপোলি যোগ দেবার পর ম্যারাডোনার একটি বিখ্যাত উক্তি অনেকের মনে গভীর দাগ কেটেছিল।

“আমি নেপলসের গরীব শিশুদের জন্য আদর্শ হতে চাই, কারণ ঠিক আমার মতোই, যেমনটা আমি বেড়ে উঠেছিলাম বুয়েনস এইরেসে,” বলেছিলেন ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনা ফুটবল ইতিহাসের এমন এক চরিত্র যাকে অনেক মানুষই ভালোবেসেছেন, অনেকেই করেছেন সমীহ আর কেউ কেউ মনে করেন তিনি ঠিক আদর্শ হওয়ার মতো নন, অনেক সমালোচনা তার বিরুদ্ধে, কোনো কোনোটি আবার আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল, কোনো কোনোটি তাকে দাঁড় করিয়েছিল নীতির কাঠগড়ায়।

সম্প্রতি স্কুডেট্টো জিতেছে নাপোলি, ক্লাব ও ফুটবলাররা তো বটেই, গোটা শহর এই জয় উৎসর্গ করেছে ম্যারাডোনার জন্য।

ম্যারাডোনা প্রয়াত হয়েছেন ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে, বিশ্বব্যাপী ফুটবল সমর্থকদের মধ্যেই ম্যারাডোনার মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছিল, তবে দুইটা শহরে ম্যারাডোনার মৃত্যুর পরে প্রশাসনিক শোক নেমে এসেছিল, এক বুয়েনস এইরেস, দুই নেপলস-এ।

ম্যারাডোনা নেপলসকে ভালোবেসেছেন জীবনভর, নেপলসও সেটা ফিরিয়ে দিয়েছে।

এইতো সেদিন শিরোপা জয়ের পর যখন নাপোলির সমর্থকরা আনন্দ মিছিল করছিলেন বিবিসি স্পোর্টের শিরোনামে এসেছিল, “আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে”।

ম্যারাডোনার সময়টা ছিল ‘অলৌকিক’
৫ই জুলাই, ১৯৮৪, ম্যারাডোনা এই দিন আনুষ্ঠানিকভাবে নাপোলির ফুটবলার হিসেবে জনসম্মুখে এসেছিলেন, এইদিন নেপলসের মানুষের আনন্দকে পত্র পত্রিকায় ‘হিস্টেরিয়া’ লেখা হয়েছিল।

৭০ হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে বসে চিল্লাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, “আমি ম্যারাডোনাকে দেখেছি, আমি ম্যারাডোনাকে দেখেছি”।

সাতটি বছর ম্যারাডোনা সেখানে কাটিয়েছিলেন।

নাপোলিকে দ্বিতীয় সারি থেকে বিশ্বের সেরা ক্লাবগুলোর একটিতে পরিণত করেছিলেন ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনার নাপোলিকে অনেক ফুটবল ইতিহাস লেখকই, ‘ওয়ান ম্যান টিম’ বলে উল্লেখ করেছেন।

এই সময়টাকে বলেছেন অলৌকিক।

ক্লাবটির ৭০ বছরের ইতিহাসে যা হয়নি ম্যারাডোনা এসেছেন এবং দুটি লিগ শিরোপা এবং ইউরোপিয়ান ট্রফি এনে দিয়েছেন এই শহরে।

এখন ক্লাবটির বয়স ৯৭ এর মতো, ৩৩ বছর পর জিতেছে আরও একটি লিগ শিরোপা।

ম্যারাডোনা এই শহরের মানুষের অধিকার নিয়ে এতোটাই সোচ্চার ছিল যে এই শহরের লোক আর্জেন্টিনা বনাম ইতালি ম্যাচে আর্জেন্টিনার সমর্থনে ছিলেন।

সেটাই ছিল ম্যারাডোনার পতনের শুরু।

ম্যারাডোনার ইতালি থেকে বিদায়
১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি ও আর্জেন্টিনা, ম্যাচটি হয়েছিল ন্যাপলসে।

ইতালির উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে যে বিভেদ ছিল সেটাকে ব্যবহার করে ম্যারাডোনা নেপলসের সমর্থন আর্জেন্টিনার পক্ষে নিয়ে আসেন।

কিন্তু ইতালির বিদায়ের পর বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি সে দেশের মিডিয়া।

ম্যারাডোনার প্রতি সমাদর নিমিষেই বদলে গিয়ে সমালোচনায় রূপ নিলো।

গ্যাজেটা ডেলো স্পোর্টে ম্যারাডোনাকে ‘ডেভিল’ বা শয়তান নামে অভিহিত করা হয়েছিল, লা রিপাবলিকায় একটি জরিপ হয়েছিল যেখানে সবচেয়ে ঘৃণিত লোকেদের মধ্যে ম্যারাডোনার নাম এসেছিল এক নম্বরে।

ম্যারাডোনার পতনের শুরুও সেটাই ছিল, এরপর ইতালির ক্লাব বারির বিপক্ষে একটি ম্যাচে কোকেইন নিয়ে ধরা পড়েছিলেন ডোপ টেস্টে, ১৫ মাসের মতো নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।

১৯৯১ সালে ম্যারাডোনার নাম এসেছিল ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের উল্লেখ করা সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট ক্যামোরার সাথে, তখন আড়ি পেতে শোনা বিভিন্ন ফোনকলে অন্তত আট বার ম্যারডোনার কণ্ঠ শোনা যায় বিভিন্ন মাদক পাচারকারীদের সাথে।

ম্যারাডোনার নামের সাথে মাদক পাচারের কোনো অভিযোগ শেষ পর্যন্ত টেকেনি, যদি টিকে যেত প্রায় বিশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারতো।

ম্যারাডোনা শেষ পর্যন্ত নাপোলি আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে ইতালি ছাড়েন।

যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, “উত্তরের দলগুলোকে আমরা হারিয়ে দিচ্ছিলাম এবং প্রচলিত সমাজ আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল”।

ম্যারাডোনা এই ন্যাপলসের সব রূপ দেখেছেন এবং ন্যাপোলি যখন উৎসবে ভাসছে তখন তিনি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন ন্যাপোলিটনদের উদযাপনে, একারণেই ম্যারাডোনা ন্যাপোলির নামের সাথেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন এবং উঠবেন। সূত্র : বিবিসি

বিডিসংবাদ/এএইচএস